আকাশখেয়া থেকে পৃথিবী দেখা

করোনায় পৃথিবীর অসাম্যের খড়্গ আরও শাণিত হয়েছে

এই একরত্তি ভাইরাসটির আবির্ভাব ঘটল যখন, ইয়া বড় পৃথিবীটার দৃশ্যপট আক্ষরিক অর্থেই পাল্টে গেল। মানুষে মানুষে গলাগলির চিরন্তন সম্পর্ক নিয়ে উচ্চারিত হলো ‘সতর্কবার্তা’। তিন ফুট দূরত্বের একটি করে অদৃশ্য আড়কাঠি স্থাপিত হলো পরস্পরের মধ্যে। নাক-মুখ ঢাকতে মাস্ক হয়ে দাঁড়াল অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ খাপ খাইয়েও নিয়েছে দ্রুতই। একাধিক টিকা আবিষ্কারের পর বিশ্বব্যাপী সেসবের প্রয়োগ শুরু হওয়ায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো ‘নিউ নরমাল’ অপ্রয়োজনীয় শব্দবন্ধে পরিণত হবে, কথায় কথায় উচ্চারিত হবে না আর—এই আশায় বাতুলতা নেই এতটুকু। কেননা এই আশা মানুষের হার না মানার, ঘুরে দাঁড়ানোর, সময়ের সঙ্গে যুঝতে পারার ইতিহাসের নির্যাস। কিন্তু করোনাপূর্ব বা বিফোর করোনা (বিসি) এবং করোনাপরবর্তী বা আফটার করোনা (এসি)—দুই পারের দুনিয়ার কী হবে?

অতিমারির শুরুর দিকে বিসি ও এসি দুনিয়ার মিলমিশ আর হওয়ার নয়—এমন ধারণা জোর পেয়েছিল। তবে নানা মহলের ভাষ্যকার, চিন্তক ও পর্যবেক্ষকদের সেই ধারণার গোড়া থেকে ক্রমেই মাটি সরছে। করোনার তাণ্ডব যত কমজোরি হয়ে আসছে, আগের সেই ‘ওল্ড নরমাল’ দুনিয়াদারির প্রত্যাবর্তনই যেন অবিকল্প হয়ে দেখা দিচ্ছে, যার একদিকে এন্তার গরিবি, আরেক দিকে অঢেল প্রাচুর্য। কারও পেটে খাবার নেই, তো অন্যজনের সম্পদের হিসাব সাধারণ ক্যালকুলেটরে আঁটে না।

করোনায় পৃথিবীর ‘চিরকেলে’এই অসাম্যের খড়্গ আরও শাণিত হয়েছে। এর জোরালো আঘাতে ধনী-গরিব বিভাজনরেখা এতটাই প্রকট ও বিরাট হয়েছে যে আপাতদৃষ্টে তা মেরামতের অযোগ্য বলেই ঠাওর হচ্ছে। করোনাকালে কোটি কোটি গরিবসহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আরও বিপন্ন হয়ে পড়েছে, বিত্তশালীরা হয়েছে আরও টাকা–কড়ির মালিক। সোজা বাংলায়, বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছে, গরিবেরা আরও মরণদশায়।

গরিবির বেহদ বিস্তার আর নিতান্ত সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠীর ফুলে–ফেঁপে এই বেঢপ ঢোলের আকৃতি পাওয়া নাকি ইংরেজি ‘কে’ বর্ণটির আদলে ব্যাখ্যাযোগ্য। তাত্ত্বিকদের এই ভাষ্য অবশ্য দৃশ্যময়তা পায়, যখন মহাকাশও হয়ে ওঠে কারও কারও নতুন ‘অবকাশকেন্দ্র’। ‘কে’ বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী রেখাটি এতটাই ওপরে উঠেছে যে তা মহাকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে, নিম্নগামী রেখাটি মাটি ফুঁড়ে স্পর্শ করেছে পাতাল। পৃথিবীর আসল ‘স্বাভাবিকতা’ আরও বৃহত্তর অসাম্যের দলিল নিয়ে হাজির। তাই ধনী দেশগুলোয় জনসংখ্যার তুলনায় সাত-আট গুণ বেশি টিকা মজুত হয়, গরিবেরা কবে পাবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কেবল ভাতে মারা নয়, রোগবালাইয়েও গরিব মরবে ওষুধবিহীন, চিকিৎসাহীন। করোনাপূর্ব দুনিয়ার রেওয়াজ।

করোনায় পৃথিবীর ‘চিরকেলে’এই অসাম্যের খড়্গ আরও শাণিত হয়েছে। এর জোরালো আঘাতে ধনী-গরিব বিভাজনরেখা এতটাই প্রকট ও বিরাট হয়েছে যে আপাতদৃষ্টে তা মেরামতের অযোগ্য বলেই ঠাওর হচ্ছে। করোনাকালে কোটি কোটি গরিবসহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ আরও বিপন্ন হয়ে পড়েছে, বিত্তশালীরা হয়েছে আরও টাকা–কড়ির মালিক। সোজা বাংলায়, বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছে, গরিবেরা আরও মরণদশায়।

ফলে আগের মতোই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ‘মধ্যরিক্ত’ও ‘নিম্নমধ্যরিক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে অনায়াসে। বিত্তের যোগ কেবল উচ্চের সঙ্গে; করোনায় তা ‘সুউচ্চ’ হয়েছে। সুউচ্চবিত্ত ইলন মাস্কদের অবকাশযাপনের জন্য পছন্দের স্থানের তালিকায় তাই পৃথিবীর কোনো সাগর, নদী, পাহাড়, বন আর ঠাঁই পাচ্ছে না। তাঁদের গন্তব্য এখন ‘মহাকাশ’, এমনকি ভবিষ্যৎ বসতির জন্যও তাঁদের চোখ পড়েছে ভিনগ্রহ—মঙ্গলে। তবে কি পৃথিবী থেকে তাঁদের আর পাওয়ার কিছু নেই? কিংবা প্রশ্নটিকে ঘুরিয়ে এভাবেও করা যায়, পৃথিবীই বা আর কী দিতে পারে তাঁদের?

কোটি কোটি ভুখানাঙ্গা মানুষ, যুদ্ধবিগ্রহ, রোগবালাই দূষণে আকসার অপঘাত মৃত্যু, উন্নয়নের বুলডোজারে ক্ষতবিক্ষত সাগর-পাহাড়-বনবাদাড়। একদিকে খরায় পুড়ছে ফসল, অন্যদিকে বানে ভাসছে বসতি। একপাশে প্রাণ ওষ্ঠাগত করার মতো তাপমাত্রা, তো অন্যপাশে তুষারপাতের হাড়কাঁপানো হিম—এই বেহাল পৃথিবীর কাছ থেকে কীই-বা পেতে পারেন ইলন মাস্করা! শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবীতে শিল্পেরই বিকাশ হয়েছে; সেই বিকাশের হাত ধরে তৈরি হয়েছে মুনাফামুখী একশ্রেণির বেনিয়া। পুঁজিবাদ তাদের করে তুলেছে রীতিমতো দুর্বিনীত। আর প্রযুক্তির উৎকর্ষ তাদের ‘হাওয়া’বেচে কোটি কোটি টাকা পকেটে পোরার মওকা করে দিয়েছে। মাত্র ছয় ঘণ্টার ফেসবুকের সেবায় বিঘ্ন ঘটায় নাকি ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে মার্ক জাকারবার্গের। এই ছয় ঘণ্টায় অনাহারে কত মানুষ মরেছে, ক্ষুধার জ্বালায় কেঁদেছে কত শিশু, সে খবর কে রাখে?

নিজের রেস্ত ভরা ছাড়া অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত যেমন নেই সুউচ্চবিত্তদের; তাগিদ বোধ করার মতো নৈতিকতার চর্চাও অবসিত। প্যান্ডোরা পেপারস তারই নয়া প্রামাণ্য দলিল। যাঁর যত পয়সা আছে, তিনি তত পয়সার কাঙাল। মহাকাশ থেকে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে অপূর্ব সবুজ দেখায়। নভোচারীদের বয়ানে বিশ্ববাসী তা শুনেছে, ক্যামেরার চোখে ধরা পড়া ছবিতে তা দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে অনেকের। কিন্তু দিন দিন যেভাবে দারিদ্র্য আরও জেঁকে বসছে, আরও প্রকট হচ্ছে শোষণ-বঞ্চনা, পৃথিবীর এই মালিন্য কি শখের নভোচারীদের চোখে পড়ে? মূলত ধনীদের কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর সবুজও নিঃশেষ হচ্ছে, তাপমাত্রার পারদ চড়ছে চড়চড়িয়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে এখনো কি আগের মতোই সবুজ দেখায়? একটুও কি ফিকে লাগে না? এ কারণেই কি মহাকাশ ভ্রমণ শেষে ইলন মাস্ক বলেছেন, তিনি মঙ্গলেই মরতে চান?

আহা! দুঃখিনী পৃথিবী! তোমার অবস্থা এতটাই সঙিন যে তোমার বুকে কেউ কেউ নিজের সমাধিও রাখতে চায় না আর!

হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]