আক্রান্ত প্যারিস: জঙ্গি হামলার দুই অভিশাপ

হামলায় হতাহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। ছবি: রয়টার্স
হামলায় হতাহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা। ছবি: রয়টার্স

প্রচলিত যুদ্ধের লক্ষ্যটা ঘোষিত থাকে, কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার দুটি লক্ষ্য—একটি প্রকাশ্য ও অন্যটি লুকানো। সেই লুকানো উদ্দেশ্যটা সন্ত্রাসীদের সত্যিকার পরিচয়ের মতোই জানা কঠিন। প্যারিসে হামলায় সন্দেহভাজন সব জঙ্গি নিহত, তাদের সঙ্গে নিহত দেড় শ’শর মতো নিরীহ মানুষ। যারাই করুক, এই দেড় শ মানুষ হত্যা তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, তাদের উদ্দেশ্য বিশ্বকে আরও হানাহানির দিকে চালিত করা।
প্যারিস হামলার দুদিন আগে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে দুটি আত্মঘাতী বোমায় ৪৩ জনের প্রাণ গিয়েছে। প্রায় একই সময় আফগানিস্তানে নয় শিশুর মুণ্ডুহীন দেহ পাওয়া গেছে। তারও কিছু আগে মিসরের সিনাই উপত্যকায় রুশ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় ২২৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। ঘটনাগুলো যখন ঘটছে, তখন সিরিয়ায় রাশিয়া বনাম ন্যাটো জোট (যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক) মুখোমুখি। সৌদি আরব ইয়েমেনে বিমান হামলা করেও সুবিধা পাচ্ছে না। এর সমান্তরালে চীন সাগরে আমেরিকা ও চীনা নৌবাহিনী পরস্পরকে হুমকিতে রাখছে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে মার খেয়ে সিরিয়া-ইরাককেন্দ্রিক আইএস সন্ত্রাসবাদ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত গবেষণা সংস্থা র‍্যান্ড করপোরেশনের নতুন এক প্রতিবেদন। জঙ্গি হামলা আর আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধকে তাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা কঠিন।
প্যারিস হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ‘অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাউকে দায়ী করছি না’ বললেও অনেকেই ধরে নিচ্ছেন, সিরিয়ায় মার খাওয়া আইএস-ই রয়েছে এর পেছনে। লেবাননে হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে আইএস এর নামে। লক্ষ করার বিষয়, দেশে দেশে হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলো প্রগতিশীল ও জঙ্গিবাদবিরোধী শক্তি ও প্রতীক। প্যারিসের হামলার শিকার এলাকাটি তরুণ ও প্রগতিশীলদের মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। লেবাননে হামলা হয়েছে শিয়া-অধ্যুষিত এলাকায়। লেবানন ইরানবান্ধব শিয়া হিজবুল্লাহর প্রভাবাধীন এবং উভয়েরই শত্রু আইএস। রাশিয়া একই সঙ্গে আইএস ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। চীন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি নীতির বিপক্ষে।
ধরে নেওয়া চলে, এসব সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্য আইএস ও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলবিরোধীদের বিপর্যস্ত করা। যেমন রুশ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর রুশ জনমতের মধ্যে সিরিয়ায় রাশিয়ার জড়ানো নিয়ে অস্বস্তি শুরু হয়েছে।
সিরিয়া নিয়ে ডামাডোলের মধ্যে দারুণ সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি ভূমি জবরদখলের আওতা বেড়েছে। পূর্ব জেরুজালেম থেকে আরবদের বিতাড়ন করে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল আকসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণও তারা নিতে চাইছে। এর জবাবে স্বতঃস্ফূর্ত ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে প্রতিদিনই আরব ও ইহুদিদের কেউ না কেউ নিহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি পেছনে রেখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা করেছেন। রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুটনিক জানিয়েছে, ওবামার কাছে ১৯৮১ সালের যুদ্ধে দখল করা সিরিয়ার গোলান উপত্যকা ইসরায়েলের অংশ করে নেওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েল এখন কোণঠাসা। বয়কট ইসরায়েল আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, বিবেকি ইউরোপীয়রা ইসরায়েলের নিন্দা করছেন। মানবতাবাদীদের চাপে কোনো কোনো ইউরোপীয় সংসদে ইসরায়েলের নিন্দা উঠেছে। মনে হচ্ছে, সৌদি আরব, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা বেকায়দায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পশ্চিমা জনমতের সাম্প্রতিক কিছু উপলব্ধি। তালেবান-আল কায়েদা ও আইএস সৃষ্টিতে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর অবদান এখন সুবিদিত। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগুলো বুমেরাং হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, এসব সংগঠন বিশ্ব নিরাপত্তার হুমকি। পরিণামে, পশ্চিমা ভোটারদের মধ্যে তাদের সরকারগুলোর ‘সাপ হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়া’র কৌশলের সমালোচনা বাড়ছে।
এমন সময়ই ফ্রান্সে বর্বরতম সন্ত্রাসী হামলা ঘটল। কিন্তু ফ্রান্স কেন? প্রথমত, ফ্রান্সেই রয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মুসলমান। ফ্রান্স আলজেরিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে সরাসরি উপনিবেশ কায়েম করে রেখেছিল ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত। সেসব সাবেক কলোনির মুসলমানরা ফ্রান্সে বসত গাড়ে। দ্বিতীয়ত, লিবিয়ায় গাদ্দাফি আর সিরিয়ায় আসাদ সরকার উচ্ছেদের যুদ্ধে ফ্রান্স সরাসরি জড়িত ছিল। দৃশ্যপটে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ঢোকার পর ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা নিয়ে দোনোমনায় পড়ে। তৃতীয়ত, ফ্রান্সে মুসলিম-বিদ্বেষী ডানপন্থীদের উত্থান ঘটছে। ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদো আক্রান্ত হলে তারা আরও জনপ্রিয় হয়। মুসলমানদের ওপর হামলার মাত্রাও সমানতালে বাড়তে থাকে। যেকোনো জঙ্গি হামলা মুসলিম ও অমুসলিম উভয় চরমপন্থাকেই চাঙা করে।
এ অবস্থায় সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। জার্মানির মতো উদার দেশও এখন ভেতর ও বাইরের ডানপন্থীদের বাধার মুখে পড়বে। কী করুণ পরিহাস! যে সিরীয়রা আইএসের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচতে ইউরোপে ছুটছিল, তাদেরই আবার আইএসপন্থী বলে দোষানো হচ্ছে। আইএসের সমর্থক হলে তো তাদের আর স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে এসে করুণা ভিক্ষা করতে হতো না। ভেতরে আইএস, বাইরে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আতঙ্ক: বিশ্বের মুসলমানরা দুদিক থেকেই আক্রান্ত।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সন্ত্রাসী হামলার দুমুখো লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। সন্ত্রাসী হামলার তাৎক্ষণিক শিকার লোকদের হত্যা করে সন্ত্রাসীরা আসলে অন্যদের বার্তা দিতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য বৃহত্তর সমাজকে বিভক্ত, ভীত ও মারমুখী করে তোলা। ইসলামের নামে হামলা হলে মুসলমান বনাম বাকিদের শত্রুতা আরও বাড়ে। তারা এক ঢিলে মুসলমান ও অমুসলিম উভয়কেই চরমপন্থী করে তুলতে চায়। একদিকে থাকবে প্রগতিশীল মুসলমান ও ইউরো-মার্কিন জোট, অন্যদিকে থাকবে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধকামী মুসলমান তরুণ। এরই আলামত দেখা যাচ্ছে ইউরোপে। ইতিমধ্যে ফরাসি শহর ক্যালাইসে একটি মুসলিম শরণার্থীশিবিরে আগুন দেওয়া হয়েছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন, ‘হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন যুদ্ধ চলবে।’ হামলাকারীদের নাম-পরিচয় জানার আগেই মুসলমানদের ওপর হামলা থেকে অনুমান করা যায়, কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে ইউরোপে। একদিকে সিরীয়-লিবীয় শরণার্থীদের ঢল, অন্যদিকে ইউরোপীয় মুসলিম নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে মৌলবাদী শ্বেতাঙ্গরা ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত। একসময় যেভাবে ডানপন্থীরা ইহুদিদের ইউরোপের অভিশাপ ঘোষণা করে বিতাড়ন করতে চেয়েছিল এবং সেই বিদ্বেষ পুঁজি করে হিটলারের নাৎসি পার্টি ইহুদি নিধনকে জায়েজ করতে লেগেছিল; ইউরো-মুসলিমদেরও সে রকম দশায় যে পড়তে হবে না, তা কে বলতে পারে? বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সব নষ্টের গোড়া ভাবার লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। মুসলিম-অমুসলিমে এই বিভাজন যুদ্ধবাজ স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর ‘ভাগ করো শাসন করো’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মওকা এনে দেবে এবং পরিণামে শক্তিশালী করবে খোদ জঙ্গি ও তাদের রক্ষকদের।
প্যারিসে হামলার এক দিন আগে ফরাসি জরিপ সংস্থা আইএফওপির (IFOP) একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয় প্রখ্যাত লা ফিগারো পত্রিকায়। ওই জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আবশ্যকীয় সংস্কার বাস্তবায়নে ফরাসিরা অগণতান্ত্রিক ধরনের সরকার মেনে নেবে কি না? ৬৭ শতাংশ অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাটদের পক্ষে বলেছে। ৪০ শতাংশের পছন্দ অনির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী সরকার।
শার্লি এবদোর একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ফরাসি জনমতকে কতটা বদলে দিয়েছিল, এই জরিপ তার ইঙ্গিত দেয়। নতুন নাশকতার প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র হবে। ফরাসি মুসলমানদের ওপর রাষ্ট্রীয় এবং ডানপন্থী বর্ণবাদীদের দমন-পীড়ন বাড়লে তাদের অনেকেই জঙ্গিবাদী দলে নাম লেখাবে। অথবা নিজেরাই আপনা থেকে হাতের কাছে যা পায়, তা নিয়ে ঘৃণার রাজনীতিতে জড়াবে। মনে রাখা দরকার, ফ্রান্সের বেকার ও দরিদ্র মুসলিম তরুণেরা কয়েক বছর আগে বঞ্চনার প্রতিবাদে প্যারিসে দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আইএস তাঁদের আরও ভয়ংকর পথে হাতছানি দিচ্ছে। সিরীয় যুদ্ধে যোগ দেওয়া ৩ হাজার ১০০ ইউরোপীয় নিজ নিজ দেশে নাশকতা শুরু করলে কী ভয়ংকর পরিস্থিতি হবে, কল্পনা করা যায়?
আইএস যতই রহস্যময় গুপ্তশক্তি হোক, আন্তর্জাতিক শক্তির মদদ, প্রশিক্ষণ ও রক্ষাকবচ ছাড়া তাদের পক্ষে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং আইএস দমনের নামে ইউরোপ অগণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারবিরোধী পথ নিলে শুধু ইউরোপীয় সংহতিই নষ্ট হবে না, বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক হানাহানি অভূতপূর্ব স্তরে উঠবে। আইএসের ষড়যন্ত্রের গোড়া রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা নীতিতে। আরেকটি গোড়া হলো মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর প্রতি তাদের বৈরী আচরণ। তাই জঙ্গি মদদ ও জঙ্গিবাদ সহায়ক অসন্তোষের জমিন বানানো বন্ধ করতে হবে।
জঙ্গিবাদের অভিশাপ দ্বিমুখী। জঙ্গি হামলার পর অনেক ‘সভ্য’ মানুষও প্রতিহিংসায় অন্ধ হন। তেমনি নিপীড়িতদের মধ্যে জন্ম দেয় আরও বেশি জঙ্গি। এবং পরিণামে দুইয়ে মিলেই মানবিকতা, ন্যায় ও সত্যের সম্ভাবনা ধ্বংস করে।
বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার শিকার লেবানন ও ফ্রান্সের পাশে আমরা দাঁড়াব। বলব আমরাও লেবানন, আমরাও ফ্রান্স। পাশাপাশি আশা করব, ঐক্যবদ্ধ ফ্রান্স ‘জঙ্গিদের’ উসকানিতে পা দিয়ে তাদেরই অনুকরণে নির্বিচার আচরণ করবে না। অশুভ জঙ্গিবাদের শক্তিটা এখানেই যে, তা আক্রান্তকে যেমন চরমপন্থার পথে টেনে নিয়ে যায়, তেমনি হতাশ ও বঞ্চিতদেরও জঙ্গিবাদের দিকে টানে। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার দায় সবার। ইউরোপ কেবল যুদ্ধ ও বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি নয়; মানবতা, ন্যায়, স্বাধীনতা ও শান্তির বৃহত্তম খুঁটিও কিন্তু এই ইউরোপ। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ডাক দেওয়া প্যারিস কমিউনের বর্তমান উত্তরসূরিরা ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গি হিংসা ও জাতিবিদ্বেষ মোকাবিলা করবে, এটাই আশা। এই দুর্দিনে শুভবুদ্ধি ও শুভশক্তির জয় হোক।