আগাম ভোটের হিসাব–নিকাশ

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের এ বছরের নির্বাচন আগের যেকোনো নির্বাচন থেকে যে ভিন্ন রকম হবে, সেটা সহজেই অনুমান করা গিয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারি, অর্থনৈতিক সংকট ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে নির্বাচনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়বে, কিন্তু গত কয়েক দিনে পাওয়া তথ্যে নাগরিকদের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অভাবনীয় আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হচ্ছে আগাম ভোটের সংখ্যা—যুক্তরাষ্ট্রের সময় রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন নাগরিক হয় ডাকযোগে ব্যালট সংগ্রহ করেছেন অথবা ইতিমধ্যে সশরীর ভোট দিয়েছেন। ২০১৬ সালে নির্বাচনের ১৬ দিন আগে এ ধরনের ভোটের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৯ মিলিয়ন। এসব থেকে মনে হচ্ছে, ভোটারদের অংশগ্রহণের বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে একটি অভূতপূর্ব নির্বাচন হতে চলেছে।

যেসব অঙ্গরাজ্য থেকে আগাম ভোটের হিসাব সরবরাহ করা হয়, তার ভিত্তিতে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার অধ্যাপক মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড ‘ইউনাইটেড স্টেটস ইলেকশন’ ওয়েবসাইটে আগাম ভোটের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন; তিনি সব নির্বাচনের সময়ই এ তথ্য সংগ্রহ করেন। এই হিসাবে আটটি রাজ্যের হিসাব নেই, কেননা সেই সব রাজ্য নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে এ তথ্য সরবরাহ করে না। কিন্তু সেসব রাজ্য থেকেও গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে যে ভোটাররা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, অধিকাংশ ভোটারই মাস্ক পরে ভোট দিচ্ছেন। তাঁদের এ উৎসাহের সারকথাটি বলেছেন লাস ভেগাসে ভোটকেন্দ্রের সামনে চেয়ার পেতে অপেক্ষমাণ ভোটার রোনাল্ড ওটিস বয়েড। ৪৯ বছর বয়সী বয়েড ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো নির্বাচনে যদি লাইন দিয়ে অংশ নিতে হয়, এবারের নির্বাচন হচ্ছে সেই নির্বাচন।’

২০১৬ সালের নির্বাচনে সারা দেশে মোট ভোট পড়েছিল ১৩৮ মিলিয়ন, এর মধ্যে ৪৭ মিলিয়ন ভোট পড়েছিল ডাকযোগে এবং আগাম ভোট, এ রেকর্ড যে এবার ভাঙবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই নির্বাচনে ১৮ বছর এবং তার বেশী বয়সী নাগরিকদের ৬০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কালে ভোটারদের সবচেয়ে বেশি হারে ভোট পড়েছিল ২০০৮ সালে, ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ। ভোট দেওয়ার হার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কেননা, অনেক রাজ্যেই আগে যাঁরা ভোট দেননি, তাঁরাও হয় ডাকযোগে ব্যালট নিয়েছেন বা আগাম ভোট দিচ্ছেন। যেমন জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ১৫ অক্টোবর পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে যে এবার যাঁরা আগাম ভোট দিচ্ছেন, তাঁদের ২২ শতাংশ ২০১৬ সালে ভোট দেননি।

আগাম ভোট, বিশেষ করে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে আগাম ভোট দেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও ভাইরাসের কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রতিদিনই আয়োজিত একাধিক সমাবেশে বক্তৃতায় বলছেন যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে এবং তা শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ৫৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক ভোটারই চাইছেন যে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এড়িয়ে আগেই ভোট দিতে।

তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথাবার্তা অনেককে আগাম ভোট দিতে উৎসাহী করেছে এ অর্থে যে তাঁরা আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্পের কথায় তাঁর সমর্থক উগ্রপন্থীরা ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণের’ নামে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভয়ভীতি দেখাতে পারে। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে নির্বাচনের দিন সংঘাত হতে পারে এবং তা এড়াতেই তাঁরা আগে ভোট দিচ্ছেন। এক্সিওস-ইপসসের পক্ষ থেকে ৮-১৫ অক্টোবর করা জরিপে দেখা যাচ্ছে যে দেশের ২৩ শতাংশ মানুষ আশঙ্কা করেন, সহিংসতা ঘটতে পারে বা মিলিশিয়ারা সহিংসতা ঘটাতে পারে।

কিন্তু এ হার সংখ্যালঘুদের মধ্যে বেশি। কৃষ্ণাঙ্গদের ৩২ শতাংশ, হিস্পানিক ও এশিয়ানদের ৩০ শতাংশ এ রকম মনে করে। শ্বেতাঙ্গদের মাত্র ১৯ শতাংশ এ রকম আশঙ্কার কথা বলেছে। এ ছাড়া যাঁরা ডাকযোগে ব্যালট নিয়েছিলেন, তাঁদেরও অনেকে এখন আগাম ভোট দিতে কেন্দ্রে যাচ্ছেন। কেননা, ডাকযোগে পাঠানো ব্যালট বিষয়ে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টি অসত্য প্রচারের মাধ্যমে এ আশঙ্কা তৈরি করেছেন যে অনেক ভোটার মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এগুলো গণনার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হবে।

আগাম ভোটের এ হারের আরেকটি কারণ হচ্ছে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ। অনেকেই এ ধরনের আশঙ্কা করেছিলেন যে দলের উদারপন্থীদের সঙ্গে মধ্যপন্থীদের টানাপোড়েন তৈরি হবে, যার প্রভাব পড়বে দলের সমর্থকদের ওপরে এবং উদারপন্থীদের, বিশেষ করে বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থকদের সমর্থন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন পাবেন না, দলে একধরনের উৎসাহের অভাব দেখা যাবে। কিন্তু বাইডেনের প্রচার দল এ ধরনের টানাপোড়েনের আশঙ্কা তিরোহিত করতে পেরেছেন। আগামী দুই সপ্তাহে তা নতুন করে দেখা দেবে বলেও মনে হয় না।

তদুপরি জো বাইডেন এখন পর্যন্ত জাতীয় ও ব্যাটলগ্রাউন্ড বলে পরিচিত রাজ্যগুলোর জরিপে এগিয়ে আছেন; দেখা যাচ্ছে যে যাঁরা ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিতে আগ্রহী ছিলেন না, তাঁরাও বাইডেনকে সমর্থন করছেন। অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন—সেপ্টেম্বরে তিনি সংগ্রহ করেছেন ৩৮৩ মিলিয়ন ডলার; ট্রাম্পের ওঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪৭ মিলিয়ন ডলার। আগস্ট মাসেও ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন বেশি অর্থ তুলতে পেরেছিলেন।

আগাম ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট সমর্থকেরা এগিয়ে আছেন, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হিসাব অনুযায়ী ৪২টি অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ভোট দেওয়ার অনুপাত ২: ১। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এতে করে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। এখন পর্যন্ত গবেষণাগুলো এমন ইঙ্গিত দেয় না যে আগাম ভোটে এগিয়ে থাকলেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যায়। ২০১৬ সালে ফ্লোরিডা ও নর্থ ক্যারোলাইনায় আগাম ভোটে এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন, কিন্তু নির্বাচনের দিন যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পের পক্ষে থাকায় ফল হিলারির বিপক্ষে গেছে।

অন্যদিকে কয়েক দিন ধরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন রাজ্যে সমাবেশ করছেন। তিনি আশা করছেন যে ২০১৬ সালে যেমন শেষ সপ্তাহে তিনি তাঁর সমর্থকদের অনুপ্রাণিত করে কেন্দ্রে আনতে পেরেছিলেন এবং ভোটের ঠিক আগে যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁদের বড় অংশকেই তাঁর পক্ষে টানতে পেরেছিলেন, এবারও তিনি তা করতে পারবেন।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর