আগামী দিনে মুখস্থ বিদ্যা কাজে আসবে না

বুঝে পড়া ও মুখস্থবিদ্যা এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাকছবি: সুপ্রিয় চাকমা

মুখস্থ করা ‘গরুর রচনা’ আমরা কতজন বাস্তবে কাজে লাগাতে পেরেছি? শিক্ষকের শিখিয়ে দেওয়া বা নোটবই থেকে পড়া ‘মাই এইম ইন লাইফ’ রচনাটি বাস্তবে আমাদের কতজনের জীবনের লক্ষ্য ছিল?

আপনি যদি ব্যাংকে চাকরি করে থাকেন বলুন তো, আপনাকে কি ডেবিট, ক্রেডিট, লোন, মর্টগেজ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ বা ফরেন এক্সচেঞ্জের মুখস্থবিদ্যা ব্যবহার করতে হয়? নাকি আপনি এর বাস্তব ব্যবহার শিখলেই ভালো ব্যাংকার হতে পারেন? বলুন তো, একজন বিসিএস কর্মকর্তা তাঁর প্রফেশনাল জীবনে কয়টা মুখস্থ থিওরি ব্যবহার করেন? একজন উদ্যোক্তা বাস্তব জীবনে কী কী মুখস্থ করা নীতি বা কৌশল প্রয়োগ করেন? এককথায় এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর হবে, মুখস্থ করা কিছুই আমাদের কাজে আসে না। অন্যদিকে, বুঝেশুনে আপনি যদি কোনো জ্ঞানও লাভ করে থাকেন, জীবনের কোথাও না কোথাও আপনি সেই জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন।

প্রশ্ন হলো তবু কেন নির্ধারিত সময় দিয়ে লিখিত পরীক্ষা নেওয়াকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো মূল্যায়নের (assessment) মূল উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? কেন উচ্চশিক্ষায়ও একজন শিক্ষার্থীকে মুখস্থবিদ্যায় ভর করে পরীক্ষা দিতে হয়?

বুঝে পড়া ও মুখস্থবিদ্যা এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মুখস্থবিদ্যার মূল উদ্দেশ্য হলো একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করা। মুখস্থবিদ্যা কোনোভাবেই জ্ঞান অর্জনের উপায় হতে পারে না। যারা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান বা যাঁরা বাস্তব পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজেকে ভালো একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চান, তাঁদের দরকার প্রকৃত জ্ঞান অর্জন। আগামীর পৃথিবীতে শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। যোগ্যতা প্রমাণ করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। মুখস্থবিদ্যা কোনোমতে একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করে দিতে পারে, কিন্তু যোগ্যতা ও দক্ষতা এনে দিতে পারে না।

আমাদের প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ে যা পড়ানো হয়, তার অধিকাংশই ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পারে না। এর বড় কারণ হলো আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইগুলোর লেখা বা অনুমোদন গবেষণা সাপেক্ষে হয় না। প্রশাসন তাদের নিজের মতো করে কিছু লোক নিয়োগ দেন, যাঁরা পাঠ্যবই নির্বাচন করেন। কোন ধরনের জ্ঞান অর্জন বাস্তবসম্মত, যা কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে? কোন ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি তাদের মুখস্থ করার দিকে ঠেলে দেবে না—এসব ভাবনা যেমন আমাদের পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না, তেমনি শিক্ষক নির্বাচন বা শিক্ষক প্রশিক্ষণেও ভূমিকা রাখে না। তাই এই ছোট বয়সের অবুঝ শিক্ষার্থীদের আমাদের চাপিয়ে দেওয়া মুখস্থবিদ্যা অর্জন করে বড় হতে হয়।

আমাদের উচ্চশিক্ষার অবস্থা আরও বেশি নাজুক ও অবৈজ্ঞানিক। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের পর পরই তাদের ক্লাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একজন ভালো ছাত্র তার নিজস্ব বিষয়ে অনেক ভালো জ্ঞান রাখবেন, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ভালো ছাত্র মানেই একজন ভালো শিক্ষক হবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কোন পদ্ধতিতে পড়ালে ছাত্রছাত্রীরা সহজেই শিখতে পারবে, পরীক্ষা বা মূল্যায়ন কী ধরনের হলে একজন শিক্ষার্থী ভালো করবে, তা একজন নতুন শিক্ষকের জানা না-ও থাকতে পারে। তাই একজন প্রভাষক নিয়োগের পর তাকে ট্রেনিং দেওয়াটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আমাদের সরকারি বা বেসরকারি কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য কোনো ধরনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে, একটি ভালো শিক্ষাব্যবস্থার কিছু মৌলিক দিক রয়েছে। প্রথমত গবেষণায় দেখা গেছে ‘পরীক্ষামূলক অ্যাসেসমেন্টের’ (summative assessment) তুলনায় ‘গঠনমূলক অ্যাসেসমেন্টের’ (formative assessment) মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী আট গুণ বেশি শেখে। ‘গঠনমূলক অ্যাসেসমেন্টের’ মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বুঝতে পারে তার কোথায় ভুল হয়েছে এবং কীভাবে করলে তা সঠিক হতো। এতে সে তার ভুল শুধরে পরে ভালো ফলাফল করতে পারে। অন্যদিকে ‘পরীক্ষামূলক অ্যাসেসমেন্টে’ শিক্ষার্থী শুধু তার পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারে। তাকে আর শুধরে ওঠার সময় দেওয়া হয় না। তা ছাড়া ‘পরীক্ষামূলক অ্যাসেসমেন্টে’ শিক্ষার্থীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষা শেষ করতে হয়। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে যারা কোনো সমস্যার সমাধান করতে কিছু বেশি সময় নেয়। কিন্তু তাদের করা সমাধান নির্ধারিত সময়ে করা অন্য পাঁচজন শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক গুণ ভালো হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৯০ শতাংশের বেশি অ্যাসেসমেন্ট হয় পরীক্ষামূলক (summative)। এতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয় না।


দ্বিতীয়ত, ভাসা ভাসা শিক্ষা (surface learning) এবং গভীর শিক্ষার (deep learning) মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কতগুলো বিষয় সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা নেওয়া আর ওই বিষয়গুলো বাস্তবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে তার গভীরে পৌঁছানো এক কথা নয়। বাস্তবভিত্তিক গবেষণামূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের যেকোনো বিষয়ের গভীরে যেতে সাহায্য করে। তাই উন্নত দেশগুলোতে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার (experiential learning) অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা এক দুটো মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার বিচার করে থাকি।
উন্নত দেশগুলোতে একজন নবনিযুক্ত শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে উল্লিখিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানানো হয়। বাংলাদেশে তা করা হয় না। বাংলাদেশের ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন’ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই ধরনের ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে পারে। এতে যেমন ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে তেমনি শিক্ষার মানও অনেক বাড়বে। দেশ উপকৃত হবে।

করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বের শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে এক বিপুল পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। আগে যেখানে ‘সরাসরি ক্লাস ও পরীক্ষা’ নেওয়াই ছিল শিক্ষাপদ্ধতির মূল উপায়, এখন সেখানে ‘অনলাইন শিক্ষা’ বড় স্থান করে নিয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্বের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের ক্লাস, কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট এবং পরীক্ষা অনলাইনের মাধ্যমে নিচ্ছে।

এটি সহজেই অনুমেয় যে এমনকি করোনা উত্তর পৃথিবীতে ও শিক্ষাপদ্ধতিতে একটি আমূল পরিবর্তন আসবে। আগামীর পৃথিবীতে অন্তত উচ্চশিক্ষায় ‘অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির’ চাহিদা বাড়বে। বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সরাসরি (face-to-face) এবং অনলাইন (online) এই দুইয়ের একটা সংমিশ্রণ (blended learning) ব্যবহার করে শিক্ষা দিচ্ছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনলাইনভিত্তিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে তারা করোনা-উত্তর পৃথিবীতে পুরোপুরি আগের মতো সরাসরি ক্লাস বা পরীক্ষাপদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। মিশ্র পদ্ধতিই (mixed method) হবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম।

বাংলাদেশকেও সেদিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করা এক্ষুনি শুরু করা দরকার। বাস্তবতা হলো, দেশের অল্প কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির দিকে এগিয়ে গেলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো এ বিষয়টি নিয়ে কিছু ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না।
এখানে বলে রাখা ভালো, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি মুখস্থবিদ্যা শিক্ষাকে ‘সেকেলে’ করে দিয়েছে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা সরাসরি কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারে না তাদের জন্য পরীক্ষা-পরিদর্শক থাকে না। ফলে এই পদ্ধতিতে সব পরীক্ষাই হয় ‘খোলা বইয়ে পরীক্ষা’ (open book exam)। এই ব্যবস্থা আমাদের মুখস্থবিদ্যা শিক্ষা থেকে সরে আসতে বাধ্য করবে। প্রশ্ন হলো ‘খোলা বইয়ে পরীক্ষা’ কি আসলে একটি ভালো পরীক্ষা পদ্ধতি?

যখন সরাসরি ক্লাসে পরীক্ষা নেওয়া যেত তখনো আমি অনেক সময় খোলা বইয়ে পরীক্ষা নিতাম। শুধু সেই শিক্ষার্থীই সঠিক উত্তর দিতে পারত যে পড়াশোনা করেছে। সত্যি কথা বলতে কি, বাস্তব জীবনে একজন শিক্ষার্থী যখন কোনো চাকরিতে যোগ দেবে, তখন তাদের বলা হবে না—কোম্পানিতে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর একটা মুখস্থ সমাধান দাও। তাকে বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে হবে। তখন তার কাছে বই, ইন্টারনেট সবকিছুই থাকবে, তাকে সে ক্ষেত্রে শুধু সমস্যার সমাধান পদ্ধতিটা জানতে হবে। তাহলে ‘খোলা বইয়ে পরীক্ষা’ নেওয়ায় সমস্যা কোথায়? শিক্ষার্থীদের বাস্তবভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট, স্বতন্ত্র এবং দলবদ্ধ প্রেজেন্টেশন (presentation), বিভিন্ন ধরনের বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে দিলে তারা যা শিখবে তা প্রয়োগ ও করতে পারবে। মুখস্থবিদ্যাশিক্ষা কখনোই শিক্ষার্থী, সমাজ এবং দেশের জন্য উপকারী হতে পারে না। তাই এখনই সময়, বাংলাদেশকে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার পথে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. নুসরাতে আজিজ কানাডার ওলাগমা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।