আগুনে পোড়া মিনি–মাগনা জীবন আমাদের

গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের একজনের স্বজনের আহাজারিছবি: প্রথম আলো

রোমান সাম্রাজ্যে সব পথ নাকি যেত রোমের দিকে, সব নদী যায় সাগরের দিকে। আর সাধের বাংলাদেশে, লাখো মৃত্যুর দামে পাওয়া বাংলাদেশে, সব পথ যায় মৃত্যুর দিকে। মসজিদে গিয়েও পুড়ে কাবাব হয়ে ফিরতে হয়। পাহাড়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরতে হয়, সরকারি দায়িত্ব পালনকালে সরকারি বাসভবনে নিজের বেডরুমে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় হাতুড়ির আঘাত খেতে হয়। বেডরুম থেকে মসজিদ, মাইনর থেকে মেজর—কোথায় যে কে নিরাপদ?

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে গ্যাস বিস্ফোরণে আরও মারা গেলেন ২০ জন। গত বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামে গ্যাসের পাইপলাইনে বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন সাতজন।

গত সপ্তাহে ঢাকার আজিমপুর, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জায়গায় হঠাৎ করে গ্যাস বিস্ফোরণ হতে থাকল। ভাগ্যক্রমে সেসবে মানুষ আহত হলেও একেবারে প্রাণ হারাননি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের বেলায় কেউ রেহাই পাননি। ওই সময়ে মসজিদে থাকা ৫০ জন মুসল্লিই দগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ২০ জন।

এসব ঘটনার বিচার বা বিহিত কিছুই হয় না। বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল বানিয়ে মানুষের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা সরানোর কৃতিত্ব যাঁর, বিদ্যুৎ বিভাগের সেই কর্মকর্তাকে ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের পাইপলাইন গণবিধ্বংসী হয়ে উঠেছে জেনেও তিতাস গ্যাসের যিনি বা যাঁরা অনেক মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রেখেছিলেন, তাঁদেরও কিছু একটা পুরস্কার দেওয়া উচিত। এই দেশে নীতি ও দক্ষতা না, দুর্নীতি ও অযোগ্যতাই পুরস্কারের যোগ্য। আর জনগণ তো তাঁদের পুরস্কার পাচ্ছেনই জীবনের বিনিময়ে।

যথারীতি, এখন দায় এড়ানোর খেলা চলবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, মসজিদটি অবৈধ জায়গায় নির্মিত। মসজিদের জায়গাটা বৈধ না অবৈধ, সেটা দেওয়ানি মামলা।

এতগুলো মানুষের অবহেলাজনিত মৃত্যু ফৌজদারি ঘটনা। যাঁরা এই অবহেলা করে জায়গাটিকে মাইনফিল্ডের মতো বিপজ্জনক বানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা অপরাধী। তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। অবৈধভাবে নির্মিত বলে মসজিদে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন তো আর অবৈধ হয়ে যায়নি। পাইপলাইনটি তো বৈধ ছিল, তাহলে সেটার ত্রুটি সময়মতো সারানো হলো না কেন? এলাকাবাসী বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই পাইপলাইন সারানোর জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু ঘুষ না দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসেনি। এখন বললেই হবে যে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়!

দুর্নীতি, অযোগ্যতা, লোভ আর মানুষের জীবনের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা দেশটাকে দুর্নীতির মাইনফিল্ড বানিয়ে রেখেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মাইনফিল্ডে যত্রতত্র মাইন পুঁতে রাখা হয়। সেসবের কোনোটিতে পা পড়ামাত্রই বিস্ফোরণ এবং ধ্বংস। রানা প্লাজা, তাজরীন, নিমতলীর আগুন—এসব মাইনফিল্ডের একেকটি বিস্ফোরণ। প্রতিটি খাতের দায়িত্বে যাঁরা জনগণের অর্থে নিযুক্ত, তাঁরা যদি তাঁদের কাজ কিছুটা হলেও করতেন, তাহলে এসব ঘটনা হয়তো ঘটার আগেই থামানো যেত। কিন্তু তাঁরা ব্যস্ত আখের গোছানোর কাজে, দলাদলির কাজে, উচ্চপদের মই নিয়ে কাড়াকাড়ির কাজে। আর অবহেলা, অব্যবস্থা ও দুর্নীতি সবখানে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে জায়গায় জায়গায় নিয়মিতভাবে সেসবের কুফল ফলছে। এতই অব্যবস্থা যে কোথায়, কখন দুর্নীতির মাইন বিস্ফোরণে কী বিপর্যয় ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। সম্প্রতি লেবাননে বিস্ফোরকের গুদাম ফেটে গিয়ে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ধসে গেছে শহরের বড় একটা অংশ।

বাংলাদেশেও যে একরকম অবস্থায় পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিমতলী কিংবা রানা প্লাজার ঘটনার পরেও যখন কিছু হয়নি, তখন বোকার স্বর্গেও আর বিশ্বাস নেই।

মানুষের জীবন কি মিনি মাগনায় পাওয়া জিনিস? যার যায় তার কেবল সবই যায় না, স্বজন হারানোর শোক, অর্থনৈতিক ক্ষতি, পারিবারিক বিপর্যয়ে তাদের জীবন তছনছ হয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে শুধু সাধারণ মানুষেরই কেন এত বিপদ, দায়িরা কেন উচ্চাসনে নিরাপদ?

শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ। ওদিকে নারায়ণগঞ্জের তল্লা আবাসিক এলাকা শোকে-রাগে স্তব্ধ। আগুন নেভানোর কাজ সমাপ্ত করে চলে গেছে দমকল বাহিনী। শোকবাণী, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিও ঘোষিত হবে। কিন্তু পুড়ে অঙ্গার হয়ে চেনার অতীত দেহগুলো চিনিয়ে দেবে কে? মানুষ শরীরী জীব। জীবিত মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বজনেরা মৃত মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বজনের পোড়া শরীরটা অন্তত পেতে চায় শেষবার বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য, বুকচাপা হুতাশন উজাড় করে কাঁদার জন্য।

পুড়ে কালো হওয়া কিছু শরীর অবশ্য আছে সেই মর্গে, ভাইবোনের মতো, এক পরিবারের সবার মতো পাশাপাশি শোয়ানো। কে কার বুকের ধন, কে চিনিয়ে দেবে? কে?

কোন দমকল বাহিনী এসে মাইনফিল্ড হয়ে যাওয়া দেশটাকে মানুষের বাসযোগ্য করবে? লোভের আগুন নেভাবে কোন ফায়ার সার্ভিস? দুর্নীতির গণবিধ্বংসী যন্ত্রটা ধ্বংস করে মানবিক রাষ্ট্রের দমকলটা চালু করে দেবে কে? অভিজ্ঞতা বলে, কারও হয়ে কেউ করে না। যার ব্যথা বেশি, চিকিৎসার খোঁজ তাকেই করতে হয়।

বিচার তাই হতেই হবে। মসজিদটি যদি অবৈধ জায়গায় হয়ে থাকে তবে এটা যাদের দেখার কথা তারা তা দেখল না কেন? তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কেন অভিযোগ পেয়েও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসন করল না? আর মসজিদ কমিটি, এলাকার জনপ্রতিনিধিরাই–বা কী করেছেন? এতগুলো মানুষের জীবনের মূল্যে জেগে ওঠা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সরকারি বা বেসরকারি সব কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। এসব প্রশ্নই কি বলছে না যে যাঁদের হাতে জনগণের জান ও মাল, তাঁরা যোগ্য ও সৎ ছিলেন না!

দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতাও একরকমের নিষ্ঠুরতা। কারণ, এ ধরনের লোকেরা মানুষের জীবনের চেয়ে বড় মনে করে নিজেদের লোভ-লালসাকে। তাদের হাতে জানমালের ভার তুলে দেওয়া আর শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া সমান কথা।

ফারুক ওয়াসিফ: কবি ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন