আজও অম্লান মার্কিন বিশ্বসংস্কৃতি

জো বাইডেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিষেকে আমান্ডা গোরমানের কবিতা ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’-এর স্মরণীয় আবৃত্তি লাখ লাখ মানুষকে স্পর্শ করেছে। কবিতাটা অনুবাদ করানোর জন্য শীর্ষস্থানীয় এক ওলন্দাজ প্রকাশকের কাছে এই তো যথেষ্ট। কিন্তু কাজটার জন্য আন্তর্জাতিক বুকারজয়ী ঔপন্যাসিক মেরিক লুকাস রিইনেভেল্ডকে নির্বাচন করায় তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাকটিভিস্টরা। কারণ, রিইনেভেল্ড শ্বেতাঙ্গ। তাঁদের দাবি, গোরমান যেহেতু আফ্রো-আমেরিকান, তার অনুবাদও করবে কালো মানুষ। এ কাজের জন্য একজন শ্বেতাঙ্গকে নির্বাচন করায় প্রতিবাদকারীদের একজন তো রীতিমতো ‘ব্যথা’ পেয়েছেন। প্রকল্পটি থেকে তাই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন রিইনেভেল্ড।

অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাঁর প্রেসিডেন্সি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এ যৌথ বিশ্বাসে শামিল হয়েছেন পৃথিবীর আরেক প্রান্ত জাপানের কিউঅ্যাননের স্থানীয় অনুসারীরা। কিউঅ্যানন চরম ডানপন্থী আমেরিকান ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। কিউঅ্যাননের জাপানি সমর্থকদের স্থির বিশ্বাস, আড়াল থেকে জাপান শাসন করছে দুষ্ট বিদেশিরা আর অ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে ২০১১-এর বিধ্বংসী ভূমিকম্প, সবকিছুর জন্যই দায়ী রাজপরিবার।

ভালো-মন্দ যা–ই হোক, মার্কিন সংস্কৃতির প্রভাব এখনো অটুট। অন্তত এ ক্ষেত্রে মার্কিন পতনের খবর অতিরঞ্জিত। চীনের উত্থান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিপুল সম্পদ এবং ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির বিব্রতকর প্রদর্শনী সত্ত্বেও এখনো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকে দুনিয়া।

ডানপন্থী লোকেরাই মার্কিন সাংস্কৃতিক প্রভাবকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেত। ইউরোপ আর জাপানের যুদ্ধপূর্ব সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলেরা মার্কিন ব্যবসাদারির ইতরপনা, বহুজাতিক অভিবাসী সমাজের শিকড়হীনতা আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থূল উদারতাকে গালমন্দ করত। সামাজিক বিন্যাস, একজাতিকতা আর অভিজাত সংস্কৃতির জন্য মার্কিন আদর্শ হুমকিস্বরূপ। একইভাবে চরম বামেরাও আমেরিকার পুঁজিবাদী সংস্কৃতির এ বিশ্বব্যাপী বিস্তারকে গালমন্দ করে।

কোকাকোলার পাশাপাশি বছরের পর বছর আমেরিকার সবচেয়ে সফল রপ্তানির একটা হচ্ছে প্রতিরোধের সংস্কৃতি। মার্কিন বিপ্লবই তো ফরাসি বিপ্লবকে অনুপ্রাণিত করেছে। ১৯৬০–এর দশকজুড়ে সারা দুনিয়ায় ছাত্ররা ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ করে, সেটাও তো বার্কলি আর কলাম্বিয়ার ছাত্রদের অনুকরণ। তারা শুনত মার্কিন প্রতিবাদী সংগীত। আর গ্রিসের আন্দ্রিয়াস পাপেন্দ্রুর মতো মার্কিনবিরোধী রাজনীতিবিদেরা তাঁদের অনেক আইডিয়াই তো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিতেন।

অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি, বর্ণবাদের ইতিহাস, নীতির ছুঁতমার্গ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে স্বাধীনতার অঙ্গীকার: অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শৈল্পিক আর যৌন। আর এ কারণেই ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে নাজি জার্মানির বামমার্গীয় উদ্বাস্তুরা গমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই বেছে নিয়েছেন।

আজকের যুগে প্রশ্ন হচ্ছে মার্কিন প্রভাবের বর্তমান ধারা কি অধিকতর স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়, না কম? কেউ যুক্তি দিতে পারেন জাতিতত্ত্ব আর লিঙ্গ-রাজনীতি মার্কিন ক্যাম্পাসগুলোকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। আর উদার গণমাধ্যম স্বাধীনতা, বিশেষ করে যৌন ও সংখ্যালঘুর স্বাধীনতার সুযোগ আরও প্রসারিত করেছে। তবে এসবই আমেরিকার ইতিহাস ও বিশেষ ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

এই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো আমরা নিতে পারি বা নেওয়া উচিত যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই নৈতিক ভীতি অপসারিত হবে। আবারও কায়েম হবে যুক্তি। সহিষ্ণুতা নতুন করে জীবন ফিরে পাবে। আমেরিকা এবং সারা দুনিয়ার স্বার্থেই আশা করা যায়, অচিরেই এটা ঘটবে

কিন্তু মার্কিন সংস্কৃতির এই দিকগুলো কি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের সমাজে আরোপ করা যায়? ‘পরিচয়’, ‘প্রতিনিধিত্বশীলতা’ নিয়ে মার্কিনদের এই উন্মাদনা কি সম্পূর্ণ ভিন্ন ইতিহাসের ধারক অন্য দেশগুলোর কাছে একই অর্থ বহন করে? গোরমানের কবিতা কেন কৃষ্ণাঙ্গ ওলন্দাজকে দিয়েই অনুবাদ করাতে হবে? ফরাসি মহিলা গণিতবিদের (সোফি জার্মা) নামে রাখা ফরাসি হাইস্কুলের নাম পাল্টে কেন আফ্রো–আমেরিকান কর্মীর (রোজা পার্কস) নামে রাখতে হবে?

‘জাগরণ সংস্কৃতি’র এই ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় আর উদার গণমাধ্যমকে যদি ভাসিয়ে দিয়ে থাকে, ডানপন্থীদের ভয়ংকর পাগলামিও তবে তাই করেছে। ট্রাম্প ও তাঁর অনুদার, অভিবাসনবিরোধী, খোলামেলা বর্ণবাদী বাগাড়ম্বর ইতিমধ্যে একদা উদার কিছু গণতন্ত্র থেকে একদল কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিককে বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিদেশে আমেরিকান পাগলামি ছড়িয়ে পড়ার একটা স্পষ্ট উদাহরণ জাপানে কিউঅ্যাননের বাড়বাড়ন্ত।

এই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো আমরা নিতে পারি বা নেওয়া উচিত যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই নৈতিক ভীতি অপসারিত হবে। আবারও কায়েম হবে যুক্তি। সহিষ্ণুতা নতুন করে জীবন ফিরে পাবে। আমেরিকা এবং সারা দুনিয়ার স্বার্থেই আশা করা যায়, অচিরেই এটা ঘটবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইয়ান বুরুমাদ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল, ফ্রম উইনস্টন অ্যান্ড এফডিআর টু ট্রাম্প অ্যান্ড ব্রেক্সিট বইয়ের লেখক