আঞ্চলিক জ্বালানি শক্তি হয়ে উঠছে তুরস্ক

আঞ্চলিক জ্বালানি শক্তি হয়ে ওঠার ইচ্ছা তুরস্ক কখনো গোপন করেনি। তুরস্কের অবস্থান সব দিক থেকেই মোক্ষম জায়গায়। এর দুই পাশে তেল ও গ্যাস উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চল এবং জ্বালানির ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। আর এ অবস্থানগত সুবিধাই হলো তুরস্কের হাতের ট্রাম্প কার্ড। তবে তুরস্কের কৃষ্ণসাগরে বিরাট গ্যাস মজুত আবিষ্কার আসলেই খেলার নিয়ম বদলে দেবে।

তুরস্কের এ মজুতের নাম টুনা-১ (যদিও এটা টুনা মাছের নামে নয়)। এতে রয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তুর্কি প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষে, ২০২৩ সালে এ মজুতের গ্যাস সরবরাহ শুরু করতে চান। তাঁর কথা ঠিক হলে এ মজুত দিয়ে তুরস্কের বার্ষিক চাহিদার ৭ শতাংশ মিটবে। গ্যাস ও তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশের জন্য এটা চাট্টিখানি কথা না। এ গ্যাসের মজুতপ্রাপ্তি তুরস্কের অভ্যন্তরীণ শিল্পায়নকে আরও উন্নত স্তরে নেওয়ার পরিকল্পনার সঙ্গে জুতসই হবে। শুধু অর্থনীতিই উন্নত হবে না, দেশটার আঞ্চলিক মর্যাদাও আরও বাড়বে।

যদিও শিল্পবিশারদেরা এখন পর্যন্ত সন্দিহান। তাঁরা বলছেন, এ গ্যাস মজুত কেবল তুরস্কের সাত বছরের চাহিদা মেটাবে। তা ছাড়া সমুদ্রগর্ভ থেকে এ খনিজ জ্বালানি তোলাও সহজ কাজ নয়। তুরস্কের জাতীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানিকে এ কাজ সমাধা করতে পশ্চিমা কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হবে। উপরন্তু এরদোয়ান এবং তাঁর জামাতা শিল্পমন্ত্রী বেরাত আলবায়রাক যেমন বলছেন, এ সম্পদ তুরস্কের নাজুক অর্থনীতিকে খাড়া করতে পারবে না। এ অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি লাগামছাড়া, বছরের শুরুর থেকে এ মুদ্রার মূল্যমান কমে গেছে ৫ ভাগের এক ভাগ। প্রবৃদ্ধির তুলনায় ঘাটতি বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা বলাই বাহুল্য।

সবচেয়ে গুরুত্ব হলো তুরস্কের ব্যবসায়িক সম্পর্ক—প্রথমত এবং বিশেষত রাশিয়ার সঙ্গে। ১৯৯০–এর দশক থেকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ জ্বালানির প্রায় অর্ধেকটা চাহিদা মিটিয়ে আসছে রাশিয়ার গাজপ্রম। ২০০৫ থেকে ব্লুস্ট্রিম পাইপলাইন চালু হওয়ার পর জার্মানির পরে তুরস্কই হলো রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় প্রধান ক্রেতা।

মূলত রাশিয়া-তুরস্ক ব্যবসায়িক সম্পর্কে রাশিয়াই ছিল সব সময় সুবিধাজনক জায়গায়। হোক তা কোনো কিছুর মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বেলায়। এ ধরনেরই একটি চুক্তি হলো তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস কিনতে বাধ্য।

কিন্তু এখন হাওয়া তুরস্কের পক্ষে বইতে শুরু করেছে। ২০১৮ সাল থেকে তুরস্কের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানিসহ কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া ও কাতারের কাছ থেকেই শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই তরল গ্যাস কিনছে। আর যুক্তরাষ্ট্র গ্যাস দিচ্ছে রাশিয়ার চেয়ে কম দামে। আজারবাইজান থেকেও পাইপলাইনে গ্যাস আসা শুরু হয়েছে।

কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার তুরস্কের দর–কষাকষির ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। রুশ গাজপ্রমের সঙ্গে তুরস্কের যেসব দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে, সেগুলোর নবায়ন হওয়ার কথা ২০২১ সালে। তুর্কি মধ্যস্থতাকারীরা এখন আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে দর-কষাকষি করতে পারবেন। বিকল্প সরবরাহ এবং নিজেদের গ্যাসের মজুত তুরস্ককে দর-কষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে

বিপরীতে গাজপ্রমের কাছ থেকে কেনা গ্যাসের পরিমাণ ক্রমে কমছে। ২০১৭ সালে তা ছিল ৫২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৪৭ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে কমে একেবারে ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে দুর্বল অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে তুরস্কের গ্যাসের চাহিদাও কমে গেছে। ফলে কৃষ্ণসাগর দিয়ে টেনে নেওয়া রুশ পাইপলাইন—ব্লু স্ট্রিম ও তুর্ক স্ট্রিম—সক্ষমতার চেয়ে নিচে গ্যাস পরিবহন করছে। ২০০০–এর দশকে রাশিয়া যেভাবে ‘জ্বালানি অস্ত্র’ ব্যবহার করে দুর্বল প্রতিবেশীদের চাপে রাখত, বাজারের বাস্তবতার কারণে সেই প্রভাবও কমে আসছে।

কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার তুরস্কের দর–কষাকষির ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। রুশ গাজপ্রমের সঙ্গে তুরস্কের যেসব দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে, সেগুলোর নবায়ন হওয়ার কথা ২০২১ (তুর্ক স্ট্রিম পাইপলাইন) ও ২০১৫ (ব্লু স্ট্রিম পাইপলাইন) সালে। আজারবাইজান, নাইজেরিয়া ও কাতারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে। তুর্কি মধ্যস্থতাকারীরা এখন আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে দর-কষাকষি করতে পারবেন। বিকল্প সরবরাহ এবং নিজেদের গ্যাসের মজুত তুরস্ককে দর-কষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে।

তুর্কির প্রতিবেশীরা নিবিড়ভাবে লক্ষ রাখবে যে আসন্ন আলোচনায় তুরস্ক কীভাবে আচরণ করে।

ফরেন পলিসি থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ

দিমিতার বেশেভ ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার রিসার্চ ফেলো