আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা

দুর্যোগ–মহামারিতে ত্রাণ তৎপরতায় তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের সাড়া এখন দেখা যাচ্ছে নাছবি: প্রথম আলো

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের তারুণ্য সব সময়েই প্রতিবাদী। দেশের ডাকে, মানুষের ডাকে সাড়া দিতে তারা কোনো দিনও পিছপা হয়নি। সাম্প্রতিক কালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর বিদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনেও দেখা গেছে, আজকের তারুণ্যও পথে নামতে পারে। ২০২০ সালে যখন দেশে করোনার মহামারি দেখা দিল, স্কুল–কলেজ, দোকানপাট, যানবাহন বন্ধ করে দিতে হলো, দিন আনে দিন খায় মানুষেরা বিপদে পড়লেন, তখনো তো বিদ্যানন্দর মতো কিশোর-তরুণদের প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল।

এবার সবাই একযোগে নীরব নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল কেন? একটা কারণ হয়তো এই যে ফেব্রুয়ারিতে যখন সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুহার কমে গিয়েছিল, আর টিকা দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমরা ভেবে বসেছিলাম, করোনাযুদ্ধ শেষ, আমরা সবাই একযোগে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম, স্কুল-কলেজ বাদে সবকিছুই খুলে গিয়েছিল, কক্সবাজার-কুয়াকাটায় ভিড়ের চোটে হাঁটা পর্যন্ত যাচ্ছিল না। কিন্তু এপ্রিলে এসে দেখা গেল, কোভিড দেশে সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আক্রমণ করে বসেছে, মৃত্যু সিঙ্গেল ডিজিট থেকে লাফিয়ে সেঞ্চুরি পার হয়ে গেছে, তখন আমরা খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি। সরকার আবার লকডাউন দিয়েছে, তারপর কঠোর লকডাউন দিয়েছে, এতে করে গরিব মানুষেরা যে সমূহ বিপদে পড়েছে, আর নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত যে বলাও যায় না, সওয়াও যায় না ধরনের বিপদের মধ্যে আছে, এই সময় সমাজের যে কিছু করণীয় আছে, তা আমরা ভুলে গেছি। আমরা হয়তো সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারবার করে বলেছেন, আমাদের প্রধান শক্তি সামাজিক শক্তি, রাষ্ট্রীয় শক্তি নয়। স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‌‘আমাদের চিন্তার বিষয় এই যে, পূর্বে আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, যাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত—দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না?’

আমরা দেখেছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই দেশের তরুণসমাজ, সামাজিক শক্তি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসত। ১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাসের পর সবগুলো রাজনৈতিক দল ও যুব সংগঠন, সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ছুটে গিয়েছিল উপকূলে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ঢাকায় প্রতিটি সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক ত্রাণকার্য পরিচালনা করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ত্রাণকেন্দ্র খুলে সারা দেশের ত্রাণকাজের সমন্বয় করা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা রুটি বানাচ্ছে, খাবার স্যালাইনের প্যাকেট বানাচ্ছে, সে এক অপরূপ দৃশ্য।

কিন্তু এখন কি প্রাকৃতিক দুর্যোগে, কি সামাজিক দুর্যোগে, কি মহামারি—মহামারির কালে সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের সাড়াটা দেখি না কেন? তারুণ্য নিদ্রামগ্ন, তারুণ্য আত্মপর হয়ে গেছে, এটা হতেই পারে না।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এখন প্রয়াত, একবার ব্যক্তিগত আলাপে বলেছিলেন, এখন আর মিছিলে লোক হবে না। কারণ, দেশ মধ্য আয়ের হয়ে গেছে। সবার হাতে একটা করে মোবাইল আছে, তার মানে কিছু টাকা আছে এবং সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় বলে সবার একটা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন আছে। এখন আন্দোলন হবে অনলাইনে। কথাটা ভাবার মতো। এটা তিনি বলেছিলেন বছর দশেক আগে।

তবে আরও কোনো জায়গায় সুতা কেটে গেছে। রাজনীতির সঙ্গে মানুষের সংযোগের সুতা। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের বাছাই করা নয়, তাঁরা কেন্দ্রের বাছাই। তাঁরা বেশির ভাগই নিজ নিজ এলাকা থেকে রাজনীতি ও সমাজসেবার মধ্য দিয়ে উঠে আসেননি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমত এলাকার নেতা, নিজ এলাকা-মহকুমা-জেলার নেতা, তারপর তাঁরা ঢাকায় এসে কেন্দ্রের নেতা হয়েছেন। এখনকার নেতাদের অনেকেই মাটি থেকে উঠে আসেন না, তাঁদের শিকড় নেই, তাঁরা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হন এবং তাঁদের ভোট দিতে আমাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ তাঁদের স্পর্শ করবে কী, তাঁদের বেশির ভাগই এলাকায় যানও না। প্রথম আলো লিখেছে, গত বছর আওয়ামী লীগ করোনাকালে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিল, এবার তা দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। আর বিএনপি বিপর্যস্ত, মামলায় এবং অন্যান্য কারণে। সরকার কিছু করছে না, এই বাণী দেওয়া ছাড়া তারা আর কিছুই করছে না। (২২ এপ্রিল ২০২১)

এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয় না কিংবা বিশ্বব্যাংকের জরিপ লাগে না যে একজন রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে না পারলে বিপদে পড়বেন, একজন পরিবহনশ্রমিক তাঁর যান না চললে আয়ের মুখ দেখবেন না। একজন দোকানের কর্মচারী তাঁর দোকান খুলতে না পারলে বেতন পাবেন না। অনুষ্ঠান না হলে একজন শিল্পী, একজন ডেকোরেটর শ্রমিক বা মালিকের আয় বন্ধ হয়ে যাবে। গত বছর পয়লা বৈশাখ, এবারের পয়লা বৈশাখ, গত বছরের দুই ঈদ, এবারের ঈদ যাচ্ছে লকডাউনে, কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নিদারুণ সংকটে। কাজেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ঈদের আগেই ১০ লাখ ৫০ হাজার দরিদ্র মানুষের কাছে আড়াই হাজার করে টাকা পৌঁছিয়ে দিচ্ছে বিকাশ। ১৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, মোট ৩৬ লাখ দরিদ্র পরিবারের কাছে নগদ অর্থসাহায্য পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে, ৩৫ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ এবং এক লাখ কৃষক পরিবার সাহায্য পাবে। প্রত্যেক পরিবার পাবে আড়াই হাজার করে টাকা। এর বাইরে জেলা প্রশাসনের হাতে ১০ কোটি ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে গরিব, দুস্থ, অসচ্ছলদের সরাসরি সহায়তা করার জন্য। মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাতে হবে। ১১ এপ্রিল প্রথম আলোয় খবর ছাপা হয়েছিল:

‘গরিব মানুষকে সহায়তার ২ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার ও কাজ হারানো শ্রমিকদের সহায়তা দিতে তৈরি করা হয় ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার তহবিল। কিন্তু বিতরণ হয়নি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। বরাদ্দ ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে দেওয়া হয়েছে ৯১২ কোটি টাকা। ফেরত এসেছে ১০১ কোটি টাকা। শ্রমিকদের সহায়তা তহবিল দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা।’

আমরা জানি, মোবাইল ফোনের মধ্য দিয়ে নগদ অর্থ বিতরণ করতে গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন অদ্ভুতুড়ে সব পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন। এলাকা থেকে একই নম্বর ১০০ বার পাঠানো হয়েছে, এ রকমও হয়েছিল। ফলে ৫০ লাখ লোকের কাছে টাকা পাঠানোর উদ্যোগে ৩৫ লাখ লোককে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এই কাজটা ভীষণ দরকারি। সরকারের সেফটিনেট কর্মসূচির উপাত্ত আছে। বয়স্ক ভাতা প্রাপক আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আছে। আরেকটা উপায় হতে পারে, সর্বশেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার্থী সবার পরিবারকে সাহায্য করা।

যা–ই হোক, সরকারের কাজ সরকার করবে। আমরা সরকারের ভালো উদ্যোগের প্রশংসা করব, ভুলত্রুটি হলে ধরিয়ে দেব, যাতে কাজটা আরও ভালোভাবে করা যায়। অন্যায় হলে প্রতিবাদ করব।

কিন্তু আমাদের নাগরিক সমাজ গেল কই? বড় করপোরেটগুলোর সিএসআরের আওয়াজ আর ছবিও তো দেখি না। আর কোথায় গেল আমাদের তারুণ্য? সত্য বটে, মাশরাফি বিন মুর্তজা গত বছর যে আওয়াজ দিয়েছিলেন, ‘এখন যৌবন যার, বাসায় থাকার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ সেটাও জরুরি। আরেকটা কথা। দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। আমরা যদি জাকাত ঠিকভাবে দিই এবং সেটা যদি নিজ নিজ গরিব আত্মীয়স্বজনকে দিয়েই শুরু করি, যা করতে আমাদের ধর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাহলেও কিন্তু দেশে দারিদ্র্য অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। আমাদের প্রবাসীরা নিশ্চয়ই স্বদেশে তাঁদের পরিবারগুলোর কাছে টাকা পাঠাবেন। করোনাকালে সেটা পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি।

আবারও তারুণ্যকেই জেগে উঠতে বলব। কারণ তারা যদি জাগে, তাহলে বাংলাদেশ জাগবে। ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক