‘আধুনিকা’ পেটানোর এই সুখ কে দিয়েছে

তেলের কালোবাজারি নয়, ব্যাংক লুটের মহাজন নয়, মানুষ-মারা খুনি নয়; তারা মেরেছে এমন একটা মেয়েকে, যার পোশাক তাদের পছন্দ হয়নি। আসল কথা সেটা না। আসল কথা হলো, সবলের দ্বারা দুর্বলের ওপর অত্যাচার। মেয়েটি ক্ষমতাবান পরিবারের কেউ হলে হামলাকারীরা নির্ঘাত উদাস হয়ে যেত। সবার রুচি এক নয়। তা হওয়ার দরকারও নেই। আলাদা রুচির লোক দেখলে যদি আমাদের অনুভূতি আহত হয়, যদি তাকে মারার ইচ্ছা হয়, তাহলে আমরা যখন চিকিৎসা নিতে ভারতে যাই, বেড়াতে যাই নেপালে, কিংবা কাজের সন্ধানে ইউরোপে গিয়ে হাজির হই; তখন কোথায় থাকে সেই রুচির অহংকার, অনুভূতি সুরক্ষার দাপট?

হাজার হাত ঘোরা নোংরা টাকারও দাম আছে। অথচ মানুষের দাম নেই এই দেশে। না হলে কী করে পোশাকের জন্য কোনো মেয়েকে পেটানোর জোশ আসে? আধুনিক নারী পেটানোর ‘তালেবানি’ সুখ কি অনেক লোভনীয় ব্যাপার? সামলানো যায় না নিজেকে? কী সুখে সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আরও অনেক লোক। ১৮ মে, নরসিংদী স্টেশনে যে দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, তা এখন ভাইরাল। ভারতে গরুর মাংস বহনের জন্য মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য বাংলাদেশে বসে যেমন দেখা যায়, তেমনি জিনস ও হাতাকাটা জামা পরা একটি তরুণীকে নারী-পুরুষের সম্মিলিত গণপিটুনির ভিডিও-ও কিন্তু চোখের পলকে বিদেশেও চলে যায়। এমনকি আমেরিকান সিএনএন চ্যানেলেও ভিডিওটা দেখানো হয়েছে। দেখানোর সময় কিছু দৃশ্য তারা ঝাপসা করে দিয়েছে। এসব দেখে কেউ কষ্ট পাবে, কেউ ধারণা করবে স্বাধীন হলেও ঠিকঠাক মানুষ হতে পারিনি আমরা।

এই আমরা কারা? যে আমরা ফ্রান্সে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ করি, যে আমরা ভারতে মুসলমান নির্যাতনের প্রতিবাদ করি, সেই আমরা টিপ বা পোশাকের জন্য কোনো নারীকে অপমান ও নির্যাতন করার প্রতিবাদ করি কি? যদি করি তো ভালো। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে পারাই সততা। হিজাব পরার জন্য যেমন কারও মর্যাদা কমে না, না পরলেও কমার কথা নয়। পোশাকের জন্য কারও মর্যাদা বাড়া-কমা নিয়ে পারস্যের কবি শেখ সাদির গল্পের আসল অর্থটা যেন আমরা বুঝতে পারি। মানুষকে মানুষ মনে করার মাধ্যমেই আমরা আসলে মানুষ হয়ে উঠি। প্রাণীদেরও অধিকার আছে, আর ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ বলে ঘোষিত মানুষের বেলায় শুধু অধিকার নয়, মর্যাদাও দান করা হয়েছে। কাউকে অপমান করা, কারও গায়ে হাত তোলা, কারও পোশাক-চেহারা-ভাষা-রং নিয়ে খোঁচা দেওয়ায় তার মর্যাদাহানি হয়। আপনি একজনকে সব দিলেন তো মর্যাদা দিলেন না; সেই মানুষ কষ্ট পাবে।

দয়া করে দুঃখ নেবেন না। এসব কথা নসিহতও নয়, সমালোচনাও নয়। দুঃখ তো আমাদেরই, যাঁরা নিজের মর্যাদার খাতিরে অন্য মানুষের অমর্যাদায় কষ্ট পাই। কখনো কি ভাবি, অন্য কোনো দেশে গিয়ে কেবল পোশাকের জন্য এভাবে আমার মেয়েকে বা স্ত্রীকে মার খেতে হচ্ছে? পশ্চিমা কায়দার পোশাক কারও মনে জ্বালা ধরাতেই পারে। নিজের জ্বালা নিজেকেই মেটাতে হয়। বখাটে ডেকে তাদের পেটানো শুধু ফৌজদারি অপরাধই নয়, এটা বর্বরতা। আর কী আশ্চর্য, নরসিংদী স্টেশনে এক নারীকে পিটিয়েছেন অন্য কিছু নারী! কিছুদিন আগে বাসের ভেতর এক তরুণীর ওপর এভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আরেক বয়স্কা নারী। কে কাকে দোষ দেব আমরা? যে দেশে ক্রসফায়ার বৈধতা পায়, রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীরা যে দেশে গণপিটুনির উসকানি দেন; সেই দেশে পোশাকের জন্যও মানুষ পেটানো তো বটেই জায়েজ।

আরও পড়ুন

কথায় বলে ‘যদ্দেশে যদাচার’। অর্থাৎ যেই দেশে যেই রীতি, সেখানে সেটাই স্বাভাবিক। বরফের দেশের মানুষ ভালুকের মতো সাড়া গা পশমি পোশাকে ঢাকতে বাধ্য। আরবের মরুভূমির লু হাওয়া থেকে বাঁচতে পুরুষেরাও গা-মাথা ঢেকে রাখেন। বাংলাদেশের গ্রামের যে মেয়েরা বাড়ির চারপাশে ঘরোয়া পোশাকে থাকেন, তিনিই আবার যানবাহনে চড়ার আগে কান-চুল ঢাকা পোশাক পরেন। তবে স্বীকার করাও ভালো যে নারীবিদ্বেষ বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই দেশের রূপকথায় আছে, পুরুষের হাত থেকে বাঁচতে নারীকে গাছের কোটরে আশ্রয় নিতে হয়; গলায় কলসি বাঁধতে হয় ইত্যাদি। সেই দেশে নরসিংদী স্টেশনের স্টেশন মাস্টার রূপকথার ওই বৃক্ষের মতো করে আক্রান্ত মেয়েটিকে তাঁর দপ্তরে আশ্রয় দেবেন, এটাও প্রত্যাশিত। তিনি মানবতার বৃক্ষের ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র।

গণপিটুনি কোনো সংস্কৃতি নয়, এটা ক্রসফায়ারেরই ফটোকপি। ওখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের দ্বারা বেআইনিভাবে মানুষ নিহত হচ্ছেন, এখানে সাধারণ মানুষ তারই অনুকরণ করছে। ভাবছে, এটাই এখনকার নতুন স্বাভাবিকতা। গত দেড় যুগে বিভিন্ন সরকারের মাধ্যমে মানুষকে এভাবে বলপ্রয়োগে অভ্যস্ত করা হয়েছে। মারবার হাত আলাদা হলেও পদ্ধতিটা এক।

বাংলাদেশে অনেক পুরুষের চোখের দৃষ্টি এক্স-রে মেশিনের চেয়েও তেজস্ক্রিয়। নারী না হলে বোঝা কঠিন, সেই চোখের রশ্মি কতটা অতিবেগুনি। এ ব্যাপারে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষ আর মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষের মধ্যে উনিশ-বিশ আছে কি না জানি না; তবে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো বলে, নারী কোথাও পুরুষদের বদ নজরের সিসি ক্যামেরা থেকে নিরাপদ নয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে হিজাবের আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা হিজাবের পক্ষে ওয়াজ করছেন, তাঁরা যাঁকে নারীর ‘ইজ্জত’ বলে থাকেন, তাঁদের ভক্ত-শ্রোতাদের যেন বলেন, ইজ্জতহানির বদলে তাঁরা যেন সম্মানের পাহারাদার হয়। নইলে গণপিটুনির উসকানির দায়ে তাঁরাও দায়ী থাকবেন। লাগাতার গরম কথা কানে ঢুকলে যে কেউই উগ্র হয়ে উঠতে পারে।

কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটা সাজানো হয়ে থাকতে পারে। সামনে যখন নির্বাচনপূর্ব কালবৈশাখী সময়, তখন অনেক কিছুই হতে পারে। সন্দেহ করা সত্য জানার শর্ত। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের উসকানির পেছনে ধর্মীয় কারণ যত না, তার চেয়ে বেশি দেখা গেছে অন্য কিছু শিক্ষকের পেশাগত ঈর্ষা। তাই নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। আর যে সরকার প্রেস নোটের ভাষার বাইরে যাচ্ছে না, আর সেই ভাষায় যখন মানুষের বিশ্বাস কম; তখন নাগরিক তদন্ত হতে দোষ কী? নরসিংদী স্টেশনে কে উসকানি দিয়েছিল, কারা মারার জন্য তৈরি হয়েছিল; সেটা বের করা দরকার। তাদের শাস্তি না হলে এ রকম ঘটনা ঘটার হার বেড়ে যাবে।

আরও পড়ুন

আমরা বলে আসছি, গণপিটুনি কোনো সংস্কৃতি নয়, এটা ক্রসফায়ারেরই ফটোকপি। ওখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের দ্বারা বেআইনিভাবে মানুষ নিহত হচ্ছেন, এখানে সাধারণ মানুষ তারই অনুকরণ করছে। ভাবছে, এটাই এখনকার নতুন স্বাভাবিকতা। গত দেড় যুগে বিভিন্ন সরকারের মাধ্যমে মানুষকে এভাবে বলপ্রয়োগে অভ্যস্ত করা হয়েছে। মারবার হাত আলাদা হলেও পদ্ধতিটা এক। সে কারণে রাষ্ট্রীয় পদে থাকা কোনো ব্যক্তিরই প্রতিপক্ষকে চুবানো-পেটানো বা উচিত শিক্ষাদানের কথা বলা উচিত নয়।

বলপ্রয়োগের যেখানে শুরু, সেখানে সংস্কৃতির ইতি আর সভ্যতার পতন। গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা না, মতপ্রকাশ এবং পোশাক পরারও স্বাধীনতা। আর কোনো স্বাধীনতাই চূড়ান্ত নয়। সমাজ ও বাস্তবতার নিরিখে স্বাধীনতার ব্যবহার যেন আমরা করতে শিখি। কাদাপানিতে জুতা পায়ে না নামার আক্কেল যদি আমাদের থাকে, তাহলে গ্রামদেশে ফ্যাশন টিভির মডেলের কায়দায় চলাফেরা না করাই বাস্তবসম্মত কাজ। আর যদি কেউ তা করে এবং আপনার পছন্দ না হয়, তা হলে আপনি মুখ ফিরিয়ে রাখুন। টিভি চ্যানেলে কত দৃশ্য সামনে আসে, সব কী আমরা দেখি? চ্যানেল পাল্টাই না? চ্যানেল পাল্টানোর চেয়ে চোখ সরানো আরও সহজ। আরও ভালো হয় মনটা পাল্টালে। মনের ময়লা পরিষ্কার না করলে চোখের ময়লা তো যাবে না।

গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, অপমান করার অধিকারও সংবিধান কাউকে দেয়নি। আমরা একদিকে আফগানিস্তান আরেক দিকে আমেরিকান বুনো পশ্চিম হয়ে আছি। তালেবান শাসনের মতো করে নারীদের দেখার প্রবণতা বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ছবির কাহিনির মতো জোর যার মুল্লুক তার ধরনের রীতি। খুব গভীরে গেলে দেখা যাবে, বলপ্রয়োগের এই দুটি হাত আসলে একই দেহেরই অংশ। যাহোক, দশজন মিলে একজনের ওপর চড়াও হওয়ার দৃশ্য দেখলে আমার কেবল অনেক হায়েনা মিলে হরিণছানা শিকারের দৃশ্যের কথা মনে পড়ে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক এবং প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]