আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলার পাঁচালি

এবার ইংল্যান্ডের গ্লাসগোয় যখন কমনওয়েলথ গেমস জমিয়ে তোলার জন্য সব রকম প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, তখন প্রতিদিনই খবরে দেখছিলাম, স্কটল্যান্ড কীভাবে ইংল্যান্ড থেকে আলাদা হওয়ার পাঁয়তারা করছে। সামনেই এর জন্য গণভোট হবে। জিতে গেলে এ স্কটল্যান্ড তখন আর ইংল্যান্ডের হবে না। টেনিস প্লেয়ার অ্যান্ডি মারে হয়ে যাবেন স্বাধীন দেশ স্কটল্যান্ডের প্রতিনিধি। তবে এটা সবাই চায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত আছে। কিন্তু স্কটল্যান্ডের প্রাচীনপন্থীরা এখনো কিংবদন্তির রবার্ট ব্রুসের সেই পরাজয়ের কথা ভোলেনি। খেলা শুরু হওয়ার আগে এসব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বিভাজিত আয়ারল্যান্ডেরও কথা। হায়রে, সেই কবে, কোনকালে এত্তগুলো দেশ ছিল রানির মুকুটের শোভা!
রানিমাতা তা ভালোই বোঝেন, তাই যেখানে সে ‘গন্ডগোলের’ উৎপাত, সে স্কটল্যান্ডের এই আন্তর্জাতিক মেলায় যাতে কোনোমতেই যুক্তরাজ্যের পতাকা প্রদর্শিত না হয়, তার কড়া নির্দেশ ছিল। আরও নির্দেশ ছিল সর্বদেশবাদী পাঁচালি গাওয়ার। সবার জন্য সমান সংস্থান করার। না হলে ব্রিটেনের হালে পানি থাকবে না। কাউকেই ফেলা যাবে না। হলে নষ্ট হবে দেশবৈচিত্র্য!
তা থেকেই হয়তো বা এ উৎসবের সমান্তরাল নাট্যোৎসবের অন্তর খচিত হয়েছে—কে আমি, কোথা থেকে এসেছি, আমি কী করি, কী বদলাতে চাই এবং তা অর্জনের জন্য কী করতে পারি—এসব প্রশ্ন ঘিরেই। প্রশ্নগুলো সত্যি সত্যি পুরো সময় ধরেই কমনওয়েলথ ক্রাই হিসেবে বিদ্যমান ছিল। ফলে মাঠের খেলার সমান্তরাল কৃষ্টি মেলায় এই প্রশ্নমালাতেই উঠে এসেছে নির্বাচিত জাতিগোষ্ঠীর নাট্যদর্শন। ৭১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নির্বাচিত ছয়টি দেশের একটি। আর আমাদের দলেরই প্রদর্শনী ছিল ২৩ তারিখে, একেবারে শুরুতেই। অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ এই যে বাংলাদেশ থেকে দেশের ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় আসা থিয়েট্রেক্স তাদের মন মাতানো পারফরম্যান্সে সবাইকে বিমোহিত করে ফেলেছিল। মুগ্ধ বিস্ময়ে দল নিয়ে আসা তরুণ নির্দেশক তক্ষুনি অপেক্ষমাণ সারা বিশ্বের বাংলাদেশিদের জানাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন। ‘কল্পনা করতে পারেন, ৭১টি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের ৩০০ তরুণ শিল্পী স্কটল্যান্ডের ২০০ শিল্পী-সংগঠক দক্ষিণা সুন্দরীর মঞ্চায়নের পর দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। এটা আমাদের তরুণ নাট্যকর্মীদের জন্য বিশাল সম্মান। থিয়েট্রেক্স বাংলাদেশের জন্য এটা এক স্মরণীয় সন্ধ্যা হয়ে থাকবে’।
কারণ, বাংলাদেশের নাটক দক্ষিণা সুন্দরী যে ধারণ করে আছে বাংলার সর্বপ্রাণবাদী এক পাঁচালি। এ অসাধারণ নাটকটি লিখেছেন তরুণ নাট্যকার শাহমান মৈশান। অভিনয় ও পোশাক পরিকল্পনা করেছেন আতিকুর রহমান, এস এম জুম্মান সাদিক, মাহজাবীন ইসলাম, সৈয়দা ইফাত আরা ও নুসরাত শারমীন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার তরুণ শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় তাঁরই বিভাগের একদল তরুণপ্রাণ অভিনীত নাটক দক্ষিণা সুন্দরী।
বাংলাদেশের দক্ষিণে সুন্দরবন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সত্যি কি জানেন, দক্ষিণেই বাংলার বাঘিনী। একদিন হাজার বছরেরও আগে চর্যাপদের শবরী গলায় গুঞ্জা ফুলের মালা আর মাথায় বনমোরগের পুচ্ছ গুঁজে তার সুরসঙ্গী শবর কবির সঙ্গে সূর্য প্রদক্ষিণে বেরিয়ে প্রথম দেখেছিল ব্যাঘ্র ছাল পরা দেবী দক্ষিণকে। নাট্যকার বহুরূপা দক্ষিণ নিয়ে সর্বপ্রাণবাদী পাঁচালি দক্ষিণা সুন্দরীতে মূলত সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাহিনি নিয়ে এসেছেন। প্রকৃতি বিনষ্টে প্রশাসন ও সমাজের কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিতময় বর্ণনা, রয়েছে বাওয়ালিদের দুর্ধর্ষ কিন্তু দুঃসহ জীবনযাপনের কথা। সবুজ গোলপাতায় ছাওয়া বনবিবির প্রাসাদ, পোকা, পাখি, বৃক্ষ, জল আর মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের নানা কাহিনি-কথাই ছিল অন্যতম।
আমি দেখেছি খেলার আগে লন্ডনে বসেই। পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি সেন্টারে। আর তত দিনে এই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা দলটি তাদের শিক্ষক ও নির্দেশকের কারণে কন্ট্যাক্ট ও চিকেন শেড থিয়েটারে তিনটি শো করে ফেলেছে। ফুটবল দলের দূরদর্শী কোচের মতোই চক্রবর্তী তাদের বিশ্বমানের অথচ মূল মাঠের বাইরে তাদের প্র্যাকটিস খেলিয়ে নিয়েছেন। কমনওয়েলথভুক্ত ৭১টি দেশের মধ্যে এই নাট্যোৎসবে বাংলাদেশ ছাড়াও ছিল ভারত, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, মাল্টা আর জ্যামাইকা। দক্ষিণা সুন্দরী নাটকটি মঞ্চস্থ হলো উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এখানে গীত, বাদ্য, নৃত্যের সঙ্গে মধ্যযুগের আখ্যানরীতি সর্বপ্রাণবাদী পাঁচালি আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলার রূপ।
সংগীত নৃত্য ও বাদ্যের যূথবদ্ধ শিল্পচিন্তায় অমিতাভ চৌধুরী, নীলা সাহা, মির্জা সাকিব, আতিকুল ইসলাম প্রমুখ গংরা এমন একনিষ্ঠ ছিলেন যে ভাবলে আমি একদম আপ্লুত হয়ে যাই। ওয়াহিদা মল্লিক পোশাক পরিকল্পনায় যে সাবধান ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। পাঁচালির ফাঁকেই কুশীলবেরা আলো-ছায়া ও সংগীতের অবসরে গায়ে পরেছেন বা ধরেছেন ঠিক বাঁধাহীন নদীর জলের মতো। তাঁদের পোশাকের ধাঁচ ছিল ‘জিনি’ প্যান্ট। তাতে নৃত্যে চলচলে ছিল তাথৈ তাথৈ। যদি পাদপ্রদীপের আলোয় ঠিক দেশে থাকি তো বলি, পোশাকের কটিবন্ধন ও পাড় থেকে বাঘিনীর ছবি—সবকিছুতেই ছিল আমাদের রিকশা আর্টের আগুন। ওপেন স্পেস থিয়েটারের চৌকোণ চত্বরের বাইরে বসা সংগীতসঙ্গীরাও ভেতরের চারজনের সঙ্গে সমান সোচ্চার। এতে অনায়াসে উঠে এসেছে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য, শিল্পকলা, কৃত্য ও বিশ্বাস। উপস্থাপনে অনুসরণ করা হয়েছে আখ্যানরীতি। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রয়েছে একজোড়া মানব-মানবী। পুরুষ চরিত্রের নাম বনা আর নারী চরিত্র চন্দ্রে। চরিত্র দুটিতে অভিনয় করেছেন আতিকুর রহমান ও নুসরাত শারমীন।
স্কটল্যান্ডের আসর এখন শেষ পর্যায়ে। অনেক দল ফিরে গেছে নিজ নিজ দেশে। বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য বিভাগ থেকে পাস করা তরুণ-তরুণীদের নিয়ে গঠিত দল থিয়েট্রেক্স। সামনে হয়তো চক্রবর্তীর আরও নতুন কাজ দেখার সৌভাগ্য হবে। তবে যে লিগেসি দক্ষিণা সুন্দরী রেখে গেল, তা অসামান্য। আশা করি এরপর শুধু ব্রিটিশ কাউন্সিল ও থিয়েট্রেক্সের বন্ধুরা নন, প্রধান পৃষ্ঠপোষক হবে বাংলাদেশ সরকার। তা করলে আজকের এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরকারের কৃষ্টিচিন্তা নিয়ে বড় একটা ইতিবাচক লাইন লেখা যেত।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।
[email protected]