আপন শক্তিতেই এগিয়ে চলেছে নারী

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের উচ্চতর স্তরে বাংলাদেশের উত্তরণের পেছনে অনেক উপাদান ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি নারীর অবদানও কম নয়। এ কথা আলোচনায় খুব বেশি আসে না। এটা দুঃখজনক। অথচ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা অনুসরণ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেই এগিয়ে চলেছে। গত এক দশকে দেশের রপ্তানি আয় মার্কিন ডলারের হিসাবে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ফলেই বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় সফল অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক খাত, যা প্রচলিত ভাষায় গার্মেন্টসশিল্প। আর গার্মেন্টস মানেই নারী কর্মীসমৃদ্ধ একটি শিল্প খাত। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার কথাটা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর প্রতিবেদনেও কিছুটা এসেছে।

তাহলে দেখুন, নারীর অবদান আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কত বড়। তৈরি পোশাক খাতসহ আরও অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এখন শ্রমিক বা মধ৵ম স্তরের নারী কর্মীরা তো কাজ করছেনই, সেই সঙ্গে পরিচালক ও মালিক হিসেবেও নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এটা আমাদের বড় অর্জন।

তারপরও আমরা দেখি নারী পদে পদে বাধাগ্রস্ত হন। বেসরকারি খাতে বেতনবৈষম্য তো আছেই; নারী নির্যাতন প্রতিদিন ঘটছে। যাঁরা অফিস-আদালতে চাকরি করেন, তাঁদের অনেক ক্ষেত্রে সহকর্মীদের বাঁকা মন্তব্য শুনতে হয়—ও, আপনারা তো দু-চার বছরের মধ্যে ছয় মাস করে দুই দফায় এক বছর মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। চিন্তা কী!

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গত সপ্তাহে সেভেন রিংস্‌ সিমেন্ট ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়গুলো আলোচনা হয়। গত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সেভেন রিংস্‌ সিমেন্ট ও প্রথম আলো আলোচনার আয়োজন করে। এবারের আলোচনার মূল বিষয় ছিল ‘নির্মাণ ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনায় নারী’। এর দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, নারী এখন ব্যবসা ব্যবস্থাপনায়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকানায়ও শীর্ষ অবস্থানে চলে আসতে শুরু করেছেন। তঁাদের কথা থেকে আমরা জানতে চেয়েছি নারীর শীর্ষ পদে অবস্থানের পথে মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী এবং কীভাবে সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। আবার অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্রমান্বয়ে উচ্চতর পদে যাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুতি কী থাকতে হবে।

বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী খুব চমৎকার একটা কথা বলেছেন। তিনি মধ্যবিত্ত সমাজের জাগরণের আহ্বান জানিয়ে বললেন, নারীদের আস্থা ও সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা দরকার।

নারীদের ঘরসংসার সামলাতে হয়। সন্তান পালনেও তাঁর ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। এত কিছুর পর অফিসে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হয়। প্রতিটি অফিসে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকতে হবে। আবার একটু বড় হলে স্কুলের ব্যবস্থাও এমন থাকতে হবে যেন অফিস, পড়াশোনা ও ঘরসংসারের মধ্যে সব কাজ সহজে সমন্বয় করা যায়। সে ক্ষেত্রে স্বামী চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী হলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্যোগ স্বামীর দিক থেকেও আসতে হবে। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই আজকাল এসব ব্যবস্থা রয়েছে।

এখন তো অনেক পরিবারে শিশুর মা সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান, পড়াশোনা করতে সহায়তা করেন। এই শিশুরা মায়ের সান্নিধ্য বেশি পায়। ফলে ব্যবসা বা চাকরিতে উঁচু পদে উঠতে হলে সংসার ও কর্মক্ষেত্রের দায়দায়িত্ব ও কাজ এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে, যেন তাঁদের শিশু মা-বাবার সান্নিধ্যলাভে ঘাটতি অনুভব না করে। এই অর্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজের সদস্যদের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই নারীর উচ্চতর পদে ভূমিকা রাখা সহজ হবে।

বিএসআরএম ইস্পাতশিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তেহেসীন জোহের বলেন, নারীর চিন্তাচেতনায় সৃজনশীলতা থাকতে হবে। গতানুগতিক ছকবাঁধা চিন্তার বাইরে আরও বড় কিছু ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসার জন৵ নারীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সেভেন রিংস্‌ সিমেন্টের পরিচালক তাহমিনা আহমেদ, বাংলাদেশ রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার নাজনীন আরা তাঁদের কাজের বড় বড় চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জয়দেবপুর থেকে আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন দোলা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সালমা বেগম। তিনি নির্মাণশিল্পসামগ্রীর বিক্রয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। স্বামী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েরাও বিক্রয়কেন্দ্রে কাজ করেন। তিনি বলেন, তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এলাকার সবার সহযোগিতা পান। সে রকম একটি আবহাওয়া তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন।

আমরা উন্নয়নশীল দেশে যাচ্ছি। আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। তাঁদের আছে সাহস, উদ্যম, সৃজনশীলতা। এই তরুণসমাজের অর্ধেকই নারী। নিশ্চয় সেই নারীদের অনেকেই শুধু চাকরিক্ষেত্রে নয়, ব্যবসাক্ষেত্রেও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবেন। তাহলেই দেশ সত্যিকার অর্থে তার সব শক্তি কাজে লাগাতে পারবে।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক

[email protected]