আপনি কি ক্যাসেটে পেনসিল ঢুকিয়ে ফিতা টেনেছেন

আপনি কি রেডিওতে ‘উত্তরণ’ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন? সকাল সকাল ঢাকা রেডিওতে ‘আজকের ঢাকা’ শুনতেন? সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে শুনতেন সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’? রাত পৌনে আটটায় শুনতেন বিবিসির খবর? আপনি কি রেডিওতে ‘অনুরোধের আসর’ শুনেছেন? রেডিওতে নাটক শুনতেন? আপনি কি রেডিওতে মোহামেডান-আবাহনী ফুটবল ম্যাচের হামিদ ভাইয়ের ধারাভাষ্য শুনেছেন? আপনি কি রেডিওতে গানের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখতেন?

আপনি কি বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দেখে পত্রমিতালি করেছেন? পিতার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছেন?

আপনি কি ৩৫ টাকা করে ক্যাসেট কিনে তপন চৌধুরী কিংবা চিত্রা সিংয়ের গান শুনেছেন? সেই ক্যাসেটের ফিতা কি পেঁচিয়ে যেত? তখন ফিতা টেনে বের করে আঙুল টিপে সোজা করে ক্যাসেটের ফুটায় পেনসিল কিংবা বলপেন ঢুকিয়ে ফিতা টেনেছেন? আপনি কি পাড়ার দোকান থেকে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে এনে বাসার ভিসিপি কিংবা ভিসিআরে দেখেছেন? আপনি কি ভিসিপি বা ভিসিআর সেট ভাড়া করে বাসায় এনে ভালোমন্দ ছবি দেখেছেন? আপনি কি টিকিট কেটে ভিসিআরে সিনেমা দেখেছেন?

আপনি কি সিনেমা হলের সামনে হাউসফুল ঝুলতে দেখেছেন? সিনেমার কাউন্টারের ভিড় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনেছেন? টিকিটের কালোবাজারির কাছ থেকে টিকিট কিনে সিনেমা দেখেছেন? সিনেমা দেখতে গিয়ে ফেরার সময় চায়নিজ খেয়েছেন? আপনি কি আংশিক রঙিন সিনেমা দেখেছেন?

আপনি টেলিফোনের ডায়ালে ছোট্ট তালা ঝুলতে দেখেছেন? আপনি কি ফোন করার প্রয়োজনে বা কল ধরার ডাকে পাশের বাড়িতে ছুটে গেছেন? আপনার পাড়ায় কি টেলিফোনের এক্সচেঞ্জ বসিয়ে ইন্টারকমের মাধ্যমে টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল? তারও আগে ফোন করার জন্য প্রথমে এক্সচেঞ্জে ফোন করে তারপর নম্বর বলে দেওয়ার কথা কি এখনো আপনার মনে পড়ে?

আপনি কি টেলিগ্রাম করেছেন? টেলিগ্রাম পেয়েছেন?

আপনি কি রেডিও-ট্রানজিস্টরের গায়ে ছিট কাপড়ের কভার দেখেছেন? আপনার রেডিওর কি লাইসেন্স ছিল? প্রতিবছর লাইসেন্স ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতেন? আপনার কি টেলিভিশনের লাইসেন্স ছিল? (টেলিভিশনের লাইসেন্স করার নিয়ম এখনো প্রচলিত আছে কি না, আমার অবশ্য জানা নেই)

আপনার কি বাইসাইকেলের লাইসেন্স ছিল?

আপনি টেলিভিশনের নিচে চারটা খুঁটি দেখেছেন? আপনি কি টেলিভিশনে দূরদর্শন দেখার জন্য অ্যানটেনায় বাটি লাগাতে দেখেছেন? অ্যানটেনার বাঁশ একজন ঘোরাচ্ছে, আর আপনি ঘরের টিভিতে দাঁড়িয়ে ‘আসেনি’, ‘এসেছে’, ‘চলে গেছে’, ‘আবার বামে ঘোরা’ বলে চিৎকার করেছেন? আপনার বাবা কি ‘ছেলেপুলেদের লেখাপড়া নষ্ট হবে’ বলে বহুদিন বাড়িতে ডিশ অ্যানটেনার লাইন নিতে দেননি?

আপনি কি ফ্লপি ডিস্ক ব্যবহার করেছেন? কম্পিউটারের ঘরে এসি আছে, অন্য কোনো ঘরে নেই, এই পরিস্থিতি দেখেছেন? কম্পিউটারের ঘরে ঢোকার সময় পায়ের জুতা-স্যান্ডেল খুলে রেখেছেন? আপনি কি প্রথম কম্পিউটারে ছবি এঁকে গৌরববোধ করেছিলেন? প্রথম রঙিন মনিটর দেখে চওড়া হাসি দিয়েছিলেন?

আপনি কি ডিজিটাল ঘড়ি পরে লোকজনকে ফুটানি করতে দেখেছেন?

আপনি কি পেজার দেখেছেন? কোমরে পেজার বাজছে, লোকেরা ফোনের কাছে গিয়ে ফোন করে জানছে কী ব্যাপার, এটা ঘটতে দেখেছেন? আপনি কলার আইডি ফোন পেয়ে খুশি হয়েছিলেন?

আপনি কি কর্ডলেস ফোন ব্যবহারকারীদের ভাব নিতে দেখেছেন? আপনি প্রথম সিটিসেলের সেলফোন ব্যবহারকারীদের ল্যান্ড থেকে আসা ফোন কেটে দিতে দেখেছেন? আপনি হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে মাছের বাজারের দোকানির মুঠোফোন ব্যবহার নিয়ে পরিবেশিত কৌতুক দেখে হেসে উঠেছেন?

এই সব প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আপনি বাংলাদেশে কোভিডের টিকা নেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। টিকা নিন। সাবধানে থাকুন। সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন।

এই সব প্রশ্নের উত্তরে যাঁরা না বলবেন, তাঁরা নতুন প্রজন্ম।

হ্যাঁ-অলারা পুরোনো প্রজন্ম। নতুন প্রজন্ম আর পুরোনো প্রজন্মের ব্যবধান থাকবেই।

হ্যাঁ-অলারা দিনে কাজ করে, রাতে ঘুমায়। না-অলারা রাতে জেগে থাকে, দিনে ঘুমায়। এটা কেন হয়, গবেষণা করলে আরেকটা নোবেল পুরস্কার পাওয়া যেতে পারে। এর আগে ২০১৭ সালে দেহঘড়ি বা বডিক্লক নিয়ে গবেষণা করে চিকিৎসায় নোবেল পেয়েছিলেন জেফরি সি হল, মাইকেল রোজব্যাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং। নতুন প্রজন্মের দেহঘড়ির সময়চক্র কেন বদলে গেল, তারা কেন রাতে জেগে থাকে, দিনে ঘুমায়, এটা আবিষ্কার করা দরকার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ‘ভবিষ্যতের মানুষ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ভবিষ্যতের মানুষদের মাথা থাকবে বড়, কারণ তারা মাথা খাটাবে বেশি, হাত-পা থাকবে ছোট, পেট থাকবে ছোট, কারণ তারা কায়িক শ্রম করবে না, খাবে কম। শুধু আঙুলগুলো বড় থাকবে, কারণ তারা যন্ত্র টেপাটিপি করবে। শহীদুল্লাহ তো ডিজিটাল বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি দূরদর্শী ছিলেন। আঙুল বেশি কাজে লাগবে, এটা তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছিলেন, তা তাঁর দূরদর্শিতারই প্রমাণ। এখন সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে বুড়ো আঙুল, স্মার্টফোনে টেক্সট বার্তা লেখার জন্য। আপনি নতুন প্রজন্মের সদস্যদের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, তারা দুই বুড়ো আঙুলে এত দ্রুত টাইপ করছে যে এত মুষলধারে বৃষ্টিও পড়ে না।

আগে বই বলতে ছিল কাগজের বই, পড়ে লোকে সিনেমাকে বই বলতে শুরু করলে সত্যজিৎ রায়কে বলতে হলো, বই নয়, সিনেমা। তারপর লাইব্রেরি মানে দাঁড়াল ভিডিও লাইব্রেরি। এখন বই মানে বুক, আর বুক মানেই ফেসবুক। তা না হলে ম্যাকবুক। আগে স্ট্যাটাস মানে ছিল সামাজিক মর্যাদা, এখন স্ট্যাটাস মানে ফেসবুকের স্ট্যাটাস। তাতে ভালো হয়েছে না মন্দ হয়েছে, তা আমি বিচার করতে যাব না। তবে ঘরে বসে পৃথিবীর বড় বড় লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়তে পারছি, গুগল করে রবীন্দ্ররচনাবলি ঢুঁড়তে পারছি, এর চেয়ে বড় সুবিধা আর কিছুই কল্পনা করতে পারি না।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক