আপনি ভেসে যেতে পারেন, তলিয়েও যেতে পারেন

বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম নগরীর রাস্তা ও নালা একাকার হয়ে যায়

উন্নয়নের স্রোতে আপনি ভেসে যেতে পারেন, এমনকি তলিয়েও যেতে পারেন। শুনতে হেঁয়ালির মতো মনে হলেও মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দু-দুটি মৃত্যু কথাটিকে সত্য প্রমাণ করেছে। মাসখানেক আগে (২৫ আগস্ট) এক বর্ষণমুখর দিনে চট্টগ্রাম শহরের জলমগ্ন মুরাদপুরে নালায় পড়ে ভেসে যান ছালেহ আহমেদ নামের একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, কীভাবে দিনেদুপুরে ঘেরা-বেড়াহীন একটি নালায় পড়ে ভেসে গেলেন ছালেহ আহমেদ। লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জলজ্যান্ত মানুষটির হঠাৎ পা হড়কে যাওয়া এবং তারপরই অকূলে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি সাধারণ মানুষকে ব্যথিত ও বিস্মিত করেছিল বটে, কিন্তু নগরের সেবা সংস্থাগুলোর কোনোটিই এতে খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছিল বলে মনে হয় না। দেয়নি যে তার প্রমাণ ওই নালার কাছে গেলেই পাওয়া যাবে। সেই বিপজ্জনক স্থানে নেহাত একটি দড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে, আর একই মোড়ের অপর পাশে সেই প্রতিবন্ধকতাও নেই। এই যে মানুষের মৃত্যুকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা, এখান থেকেই পরবর্তী দুর্ঘটনার শঙ্কা তৈরি হয়। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নগরের আগ্রাবাদ এলাকার ঢাকনাবিহীন একটি নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী সাদিয়ার মৃত্যুতে সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো!

এ ধরনের ঘটনার পর নগরবাসীর মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই দুর্ঘটনার দায় কার? কিন্তু এ প্রশ্নের কোনো যথার্থ উত্তরও আপনি পাবেন না।

কারণ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র বলবেন, ‘আগ্রাবাদে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে সিডিএ। তাই সেখানে মেইনটেন্যান্সসহ অন্যান্য দায়িত্ব তাদের।’ এ কথা শুনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে বলবেন, ‘সিডিএর দোষ ধরা ছাড়া মনে হয় সিটি করপোরেশনের কোনো কাজ নেই। ...ময়লা পরিষ্কার না করার কারণে সেখানে পানি কতটুকু ছিল, বোঝা সম্ভব হয়নি। ভালোমতো পরিষ্কার করলে দুর্ঘটনা ঘটত না।’

আগেও দেখেছি, জলাবদ্ধতাসহ নগরবাসীর যেকোনো দুর্ভোগের সময় সিটি করপোরেশন ও সিডিএ এ রকম পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। এমন নয় যে করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের মধ্যে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কোনো বিরোধের কারণে এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাঁরা। বস্তুত তাঁদের এই বক্তব্য পূর্বসূরিদের বক্তব্যেরই ধারাবাহিকতা। পূর্ববর্তী মেয়র আ জ ম নাছির ও তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম তো এ কথাগুলোই বলতেন। পদাধিকারী বদলে গেছেন, বক্তব্য বদলায়নি। তাই হতভাগ্য সাদিয়ার সহপাঠীরা ‘দায়ী কে?’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে যতই মানববন্ধন করুক, এর সদুত্তর মিলবে না।

এ কথা বলা বাহুল্য, চট্টগ্রামে এখন যে পরিমাণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে, নিকট অতীতে এ রকম আর দেখা যায়নি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আউটার রিংরোড, ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পসহ এক লাখ কোটির বেশি টাকার উন্নয়নকাজ চলমান। এসব কাজ শেষ হলে এই নগর ও নাগরিক জীবন তো বটেই, দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে সুফল ভোগের আগেই নানাভাবে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে নগরবাসী।

জলজ্যান্ত মানুষটির হঠাৎ পা হড়কে যাওয়া এবং তারপরই অকূলে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি সাধারণ মানুষকে ব্যথিত ও বিস্মিত করেছিল বটে, কিন্তু নগরের সেবা সংস্থাগুলোর কোনোটিই এতে খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছিল বলে মনে হয় না।

চট্টগ্রামে ১৫ থেকে ২০টি সেবা সংস্থা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সংস্থাগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এ কারণে এক মন্ত্রণালয়ের গৃহীত কর্মকাণ্ড অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে কোথায় সাংঘর্ষিক বা কোথায় পরিপূরক, এ ব্যাপার তো বোঝা যাবে মাঠপর্যায়ে এসে। এখানে পরস্পরের কাজকে বাধাগ্রস্ত না করে কীভাবে সুচারুভাবে তা সম্পন্ন করা যায়, তা নজরদারি করার দায়িত্ব কারও না কারও ওপর ন্যস্ত করা দরকার। এই সমন্বয়ের জন্যই চট্টগ্রামের তিন-তিনবারের নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ‘নগর সরকার’ কথাটার ওপর বারবার জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই দাবি হালে পানি পায়নি।

১৫ থেকে ২০টি সেবা সংস্থার মধ্যে একমাত্র সিটি করপোরেশনের মেয়রকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয় বলে অন্যান্য সংস্থার প্রধানদের তাঁর অভিভাবকত্বে কাজ করা ছিল যুক্তিসংগত প্রস্তাব। মেয়রকে প্রধান করে নগর সরকার গঠন তো দূরে থাক, বরং আগে মেয়রের হাতে যেটুকু ক্ষমতা ছিল, তা-ও ক্রমান্বয়ে কমেছে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮২ সালের ‘অর্ডিন্যান্স অব সিটি করপোরেশন’-এর ভিত্তিতে চট্টগ্রামসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন পরিচালিত হতো। এই আইন অনুযায়ী ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যাঁরা করপোরেশনের মেয়র ছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম ওয়াসা, সিডিএ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ সাতটি সেবা সংস্থার প্রধানেরা সিটি করপোরেশনের অফিশিয়াল কমিশনার ছিলেন। তাঁরা মেয়রের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থিত থাকতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার এই আইন রহিত করলে নির্বাচিত মেয়রদের ক্ষমতা আরও খর্ব হয়।

তবে এখনো নগরবাসী যেকোনো দুর্ভোগের জন্য দায়ী করেন সিটি করপোরেশনের মেয়রকে। যেমন জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করতে পারেননি বলে এর আগে অন্তত তিনজন মেয়র সমালোচিত হয়েছেন সর্বমহলে। অতঃপর করপোরেশনের পরিবর্তে এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সিডিএর ওপর। সমস্যার নিরসন হয়নি। এখন জলাবদ্ধতার মৌসুমে এ দুই সংস্থা পরস্পরকে দোষারোপ করে কয়েক দিন নাগরিকদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।

শুরুতেই বলেছি, লাখো কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছে নগরজুড়ে। কিন্তু এসব কাজ কতটা পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তা নিয়েই যত সংশয়। যেমন আগ্রাবাদ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, সেখানে গাড়ির যাত্রীরা প্রায় পালকিতে দোলার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গেলে অবস্থা কী দাঁড়ায়, সাদিয়ার মৃত্যুই তো তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করতে গেলে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়মিত সংস্কার করে অন্তত যান চলাচলের উপযোগী রাখতে হবে না পথটা?

উন্নয়ন সবার কাম্য, কিন্তু জীবন তার চেয়ে কম মূল্যবান নয়। উন্নয়নকাজে নিয়োজিত সেবা সংস্থাগুলোর এই বোধোদয় কবে হবে, জানি না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক