আপিল বিভাগের রেকর্ড নিম্ন আদালতও গড়ুক

অলংকরণ : মাসুক হেলাল

দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে আমরা অসামান্য সুখবর পেলাম। আপিল বিভাগ ২৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। ১৩ জুলাই থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগের অনধিক আটজন বিচারপতি ৪৩ কার্যদিবসে ৪ হাজার ৭৩টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।

ভার্চ্যুয়াল বলে আপিল বিভাগ কোনো মামলার শ্রেণিভাগ করেননি। সব মামলাই শুনছেন। নিম্ন আদালতে সেটা ঘটেনি। তাই প্রশ্ন হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন, সেটা আমাদের দেশের অধস্তন আদালতের প্রায় ১ হাজার ৮০০ বিচারক (যঁাদের ৩০০ প্রশাসনিক দায়িত্বে) পারবেন না কেন? ৩৫ লাখ বিচারাধীন মামলার ৩২ লাখই তাই মাত্র ১ হাজার ৫০০ বিচারকের ঘাড়ে। স্মার্ট কোর্ট চলতে দিলে মামলাজট কমাতে তা ভূমিকা রাখবে।

আপিল বিভাগের সবাই জ্যেষ্ঠ। প্রযুক্তির ভালো ব্যবহার আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ পারলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের আরও ভালো পারার কথা। আপিল বিভাগের দুটি বেঞ্চের ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে গতকাল রোববার একটার আগেই ৭৪ জন আইনজীবী অংশ নিয়েছেন। একই সঙ্গে বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের ৩১টি ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ ভালোভাবেই চলছে। সেখানেও আইনজীবীদের ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি প্রাণবন্ত।

এর ভিন্ন চিত্র হচ্ছে, গত ৫ আগস্ট থেকে ভার্চ্যুয়াল নিম্ন আদালত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি জরুরি বা একমাত্র বিকল্প ছিল? জেলা বারগুলোর অনাগ্রহ ও বিরোধিতাই এর জন্য দায়ী? জেলা বারগুলোতে অসন্তোষের একটা সাধারণ কারণ আছে। সেটা হলো, হাজতি আসামিদের জামিন ছাড়া নিচের কোর্টে অন্য মামলার শুনানি বন্ধ রাখা। বিচার প্রশাসন এটা কেন করছেন, তা স্পষ্ট নয়।

লকডাউনের সময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। সে সময় আটক আসামির (ত্রাণচোরসহ) জামিন শুনানি, আসামিকে জেলে প্রেরণ, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধকরণ (তিন ঘণ্টা রিফ্লেকশনের সময় দেওয়াসহ অন্যান্য সময় বিবেচনা করলে প্রতিটি লিপিবদ্ধ করতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগেছে), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় সাক্ষী ও ভিকটিমের জবানবন্দি লিপিবদ্ধকরণ, জব্দকৃত আলামতসংক্রান্ত জরুরি দরখাস্ত নিষ্পত্তিকরণসহ প্রতিদিনের মামলার রুটিন কাজ তাঁরা করেছেন। একই সময়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও সাহসের সঙ্গে মাঠে থেকেছেন। সেটা রেকর্ডে আছে। কিন্তু জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজ রেকর্ডে নেই। কারণ, রেকর্ড অনুযায়ী তাঁরাও ২৬ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এবং জেলা জজশিপের অবশিষ্ট বিচারকদের সঙ্গে ‘সাধারণ ছুটিতে’ ছিলেন।

প্রশাসন সূত্রের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কাজ করিয়ে নথিতে আপনারা ‘ছুটিভোগীর’ তকমা দিচ্ছেন কেন? তখন জবাব পেলাম, ‘সংবিধানমতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো ছুটি নেই। ৩৬৫ দিন, ২৪ ঘণ্টাই তাঁরা ডিউটিতে।’ এই উত্তর অ-যথাযথ, অস্পষ্ট। এটা বরং প্রমাণ করছে যে সুপ্রিম কোর্টের তরফে একটা স্বীকৃতি দরকার। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা এত ঝুঁকি নিয়ে, এত সব অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ করার পরও তঁাদের করোনার ‘সম্মুখযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এরপর ১১ মে থেকে ভার্চ্যুয়ালি যখন নিম্ন আদালত খুলে দেওয়া হয়, তখন জেলার বারগুলো বিরক্ত হয়। আইনজীবীরা দেখলেন, তাঁরা ভার্চ্যুয়ালি কেবল হাজতে থাকা আসামিদের জামিনের শুনানি করতে পারবেন। অন্য কোনো ধরনের মামলা করতে পারবেন না। অথচ নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের মূল আকর্ষণ হলো এজাহারভুক্ত বা পরোয়ানার আওতায় থাকা অভিযুক্তদের জন্য জামিন শুনানি করা।

গত ৪ জুলাই আইনজীবীদের ক্ষোভ প্রশমনের একটা চেষ্টা চলে। কিন্তু সেটা ছিল অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত। কারণ, ৪ জুলাইয়ের সুপ্রিম কোর্টের পরিপত্রে শুধু চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে যেকোনো আসামির আত্মসমর্পণ করার পথ উন্মুক্ত করা হয়। অথচ দেশের ৬৪ জেলার দায়রা আদালত, অতিরিক্ত দায়রা আদালত, যুগ্ম দায়রা আদালত, পারিবারিক আদালতসহ ট্রাইব্যুনালগুলোতে আসামির আত্মসমর্পণের বিষয়গুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সুতরাং ভার্চ্যুয়াল কোর্টের বিরোধিতা থেকে নয়, আইনজীবীরা বৈষম্য, পেশা ও সমতার সুযোগ খর্বের আশঙ্কায় শারীরিক কোর্টের পক্ষে আন্দোলনের মেজাজ তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ভার্চ্যুয়ালি সব ধরনের জামিনের শুনানি করতে পারলে আপিল বিভাগের আইনজীবীদের মতোই সন্তুষ্ট থাকতেন বলে মনে হয়।

একটি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার আংশিক ডিজিটাল, আংশিক অ্যানালগ তো হতেই পারে। লক্ষ্য হলো বিচারটা করা। তা ছাড়া প্রচলিত আইনের এমন ব্যাখ্যা আছে, যা সুপ্রিম কোর্টের সমর্থনে সাক্ষ্য আইন না সংশোধন করেই অর্জন সম্ভব। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলায় ইলেকট্রনিক এভিডেন্স গ্রহণে কতিপয় শর্ত দেওয়া হয়েছে। সেই শর্ত পূরণ করে নিম্ন আদালতকে বিচার করতে দেওয়া যায় কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

একটি রাষ্ট্রের তিনটি স্তরের বিচার বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ (আপিল বিভাগ) ও মাঝের আদালত (হাইকোর্ট) যা পারবেন, নিম্ন আদালত পর্যায়ে তা পারা যাবে না, তাদের করতে দেওয়া হবে না—এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আগেই বলেছি, সুপ্রিম কোর্টে অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠ ও প্রবীণেরা প্রযুক্তিগতভাবে যা পারবেন, নিম্ন আদালতে তা আরও ভালোভাবে করা সম্ভব। কারণ, তারা অপেক্ষাকৃত তরুণ। ভার্চ্যুয়াল কোর্ট বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন।

করোনাকালে আপিল বিভাগ আরও একটি নতুন রেকর্ড তৈরি করছেন। তাঁরা শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও বসেছেন। এই দৃষ্টান্ত আমাদের তরুণ বিচারকদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে। অনেক দেশ প্রথাগত ‘দিনের বেলায় অফিস টাইমের’ ধারা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। যুক্তি হলো, একটি মামলার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ একমত হলে বিকেল, সন্ধ্যা বা রাতে কী আসে যায়। সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করাই হলো আসল কথা।

আমরা সবিনয়ে বলতে চাই, নিম্ন আদালতে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট বন্ধ করা বিচার বিভাগীয় শাসনগত সাম্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। জেলা বারগুলোর অনেক সদস্য হাইকোর্টেও প্র্যাকটিস করেন। হাইকোর্টে যিনি ডিজিটালি মামলা পরিচালনা করতে পারেন তিনি জেলা আদালতে তা পারবেন না, এটা কী করে হয়!

১১ মে থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত নিম্ন আদালতে শুধু ‘জরুরি বিষয়’ ভার্চ্যুয়ালি বিচার্য ছিল। জরুরি বিষয়গুলো কী, তার ব্যাখ্যা ছিল না। এ কারণে বাস্তবে ৯০ শতাংশের বেশি বিচারক কেবল হাজতি আসামিদের জামিন শুনেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল শেরপুর। যেখানে হাজতি ও স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা উভয় ধরনের আসামির জামিনের দরখাস্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু শেরপুর ছাড়া দেশের সর্বত্র আসামিদের স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণের সুযোগ বন্ধ ছিল। এমনকি হত্যা, ডাকাতি, চুরিসহ যেকোনো প্রকারের মামলা-মোকদ্দমা দায়েরের পথ বন্ধ ছিল। এর ফলে সাধারণ মানুষ ও আইনজীবীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। এসব কারণেই জেলা বারগুলো ভার্চ্যুয়াল কোর্টবিমুখ হয়। শেরপুর বার ভার্চ্যুয়াল কোর্টের প্রতি অসাধারণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার কারণ তারা পুরো সুফল পেয়েছে।

১৩ জুলাই আপিল বিভাগ যেদিন প্রথম ভার্চ্যুয়াল শুনানি করেছিলেন, সেদিন উপস্থিত ছিলাম। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ (সদ্য প্রয়াত) প্রত্যেকে একবাক্যে বলেছিলেন, ভার্চ্যুয়াল কোর্ট উত্তম। এটা গতিশীল, সময় বাঁচায়। এ কথা নিম্ন আদালতের জন্যও প্রযোজ্য। আশা করব সব এখতিয়ার দিয়ে ভার্চ্যুয়াল নিম্ন আদালত যথা শিগগির চালু করা সম্ভব হবে। দরকার হলে শেরপুরের মতো যারা চাইবে, তাদের এখনই এটা করতে দেওয়া যেতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক

[email protected]