আফগানিস্তান: এর পরে কী

ওসামা বিন লাদেন
ফাইল ছবি: এএফপি

গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ব গণমাধ্যমে আফগানিস্তানে রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে বেশ কিছু নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। এসব নিবন্ধে ভাসা-ভাসাভাবে ছাড়া কেউ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় স্পর্শ করেননি। সেটা হলো নাইন–ইলেভেনের স্থপতি ও নির্বাহী ওসামা বিন লাদেনকে ১৯৯৬ সালে কীভাবে ভাড়া করা বিমানে করে আফগানিস্তানে নিয়ে আসা হয়েছিল? সুদানে তাঁর পরিচালিত ব্যবসা থেকে বিপুল টাকাও সেখানে নেওয়া হয়েছিল। নাইন–ইলেভেনের পর কোণঠাসা ওসামা বিন লাদেন কীভাবে তোরাবোরায় আমেরিকান সেনাদের ফাঁদে আটকা পড়েও পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন? সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকার কারণে ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে জনপ্রিয় ছিলেন। আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে তোরাবোরা থেকে তাঁকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া ছিল আরও বেশি মূর্খতার পরিচায়ক।

১৯৯৬ সালে সুদানের সঙ্গে আমেরিকার কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু সে সময় সুদান তাঁকে আমেরিকা অথবা সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিল। লাদেন পরিবারের উঁচু প্রভাবের কারণে সম্ভবত সৌদি আরব সে সময় সুদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমেরিকান রাজনীতিকদের সঙ্গে বিন লাদেন পরিবারের সম্পর্ক সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়েছিল। ২০১১ সালে অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর সেখান থেকে সংবেদনশীল নথি সরিয়ে নিয়েছিল আমেরিকান নেভি সিলস। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেই সব নথিতে ১৯৯৬ সালে সুদান থেকে তাঁর আফগান গমন কীভাবে আয়োজন করা হয়েছিল, সে তথ্য পাওয়া যাবে। নাইন–ইলেভেনের পর তোরাবোরা থেকে তাঁর পালানোর ঘটনাবলিও পাওয়া যাবে।

আফগানিস্তান ইস্যুতে কেউ অনেক বেশি আশাবাদী হতেই পারে। কিন্তু ভিয়েতনাম এবং ইরানের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ আশাবাদ মানানসই নয়। ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য ২০ বছর লেগে গিয়েছিল। ইরানের ক্ষেত্রে শান্তিপ্রক্রিয়া থেমে আছে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার জন্য আরও উদার এবং কম রহস্যজনক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

পত্রিকা থেকে প্রথম ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তানে আসার খবর জানতে পারি। পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে আমি সে সময় গোয়েন্দা বাহিনীকে তঁার কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখতে বলেছিলাম। তালেবানের উত্থানের পটভূমিকায় আমার একটা ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কান্দাহারের মাদ্রাসা থেকে তালেবানের জন্ম হয়েছিল। তারা নবি মোহাম্মদ মুজাহিদিন গ্রুপের অনুগত সৈন্য। তাদের মধ্যে কোনো কর্মকর্তা ছিল না। আফগান যুদ্ধবাজদের অপরাধে তারা ছিল ক্ষুব্ধ। এই যুদ্ধবাজদের হাতে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর একটা শিশু মারা গেলে তার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে সন্দেহের অবকাশ নেই যে যুদ্ধবাজদের অপরাধ এবং আফগানিস্তানে মুজাহিদিন উপদলগুলোর কোন্দল-তালেবানের উত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল।

মেজর জেনারেল নসরুল্লাহ বাবর ১৯৬৫ সালে তাঁর বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কারণে প্রশংসিত। কিন্তু তিনি আরও প্রশংসার দাবিদার পেশোয়ারে আফগানিস্তানের সব বিরোধী পক্ষকে (তাজিক বাদে) একত্র করার জন্য। কাবুলে সে সময় সরদার দাউদের শাসন চলছিল। এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার যে নসরুল্লাহ বাবর তালেবানের সৃষ্টি করেননি। তালেবান করাচিভিত্তিক জামিয়া ইউসুফিয়া বিনোরিয়ার অনুসারী। তবে তালেবানের মূল সমর্থক হলেন প্রবাসী আফগান এবং সৌদি ধনীরা। তাঁরা এক হাতে কোরআন আর অন্য হাতে ডলার নিয়ে আফগানদের মন জয় করেছিলেন। পাকিস্তান তালেবানের সৃষ্টি করেনি। তবে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তালেবানের একটা সেতুবন্ধ ছিল। আমেরিকার স্বার্থ সেখানে জড়িত ছিল। আফগানিস্তানে শান্তি আনতে তালেবানকে সেখানে একটা শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে সমর্থন করেছিল আমেরিকা।

আফগান পর্যবেক্ষকদের কাছে এ সবকিছুই পুরোনো বিষয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো কি আফগানিস্তানের জন্য কোনো সহযোগিতা করতে পারবে? এরই মধ্যে কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের বাইরে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছে। সেই হামলায় ১৩ জন আমেরিকান সেনার সঙ্গে তালেবান সদস্য এবং সাধারণ আফগান নিহত হয়েছেন। এটা স্পষ্টত দায়েশ খোরাসান গ্রুপের হামলা। এ হামলার পর বিমানবন্দর খালি করে দেওয়ার সময়সীমা বাড়াতে সম্মত হবে কি তালেবান?

আমার ধারণা হচ্ছে, তালেবান চায় যত দ্রুত সম্ভব বিমানবন্দর খালি হয়ে যাক। তারা চায় না বেশিসংখ্যক সাধারণ আফগান এবং প্রশিক্ষিত লোকজন আফগানিস্তান ছেড়ে যাক। তালেবান চায় বিশেষজ্ঞরা যেন সরকারের কাজে সহযোগিতা করে। তালেবান নেতৃত্ব শান্তি স্থাপনে প্রকৃতপক্ষেই অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে তালেবান নেতৃত্ব নাকি সব তালেবান এ নীতি নিয়েছে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।

আফগানিস্তান ইস্যুতে কেউ অনেক বেশি আশাবাদী হতেই পারে। কিন্তু ভিয়েতনাম এবং ইরানের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ আশাবাদ মানানসই নয়। ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য ২০ বছর লেগে গিয়েছিল। ইরানের ক্ষেত্রে শান্তিপ্রক্রিয়া থেমে আছে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার জন্য আরও উদার এবং কম রহস্যজনক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

এখানে ভুল করার অবকাশ নেই। রাশিয়া, চীন, ভারত এবং এমনকি পাকিস্তান—যে–ই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা আংশিক। নীতিনির্ধারক খেলোয়াড় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

নাজিমুদ্দিন এ শেখ পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব