আফগান সরকারের পতনের পর যা ঘটতে পারে

২ জুলাই আফগান সরকারের হাতে বাগরাম বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনী। এখন জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গোটানোর সব প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন সেনা ও তাদের সহযোগী ন্যাটো বাহিনী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ১১ সেপ্টেম্বরের বেশ আগেই তারা আফগানিস্তান ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে।

ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক সম্প্রতি এক নতুন গবেষণায় জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে যে যুদ্ধ চালিয়েছে, তাতে ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে ২৩ হাজার কোটি ডলার। এখন আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে পাকিস্তান, ইরান, চীন, ভারত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে এই ভেবে যে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর এ অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে তাদের কত টাকা খরচ হবে!

জুনের শেষের দিকে মার্কিন গোয়েন্দারা সিদ্ধান্ত দেন যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যে আফগান সরকার ভেঙে পড়তে পারে। তালেবান উত্তর আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কয়েক ডজন জেলা ও প্রধান প্রধান শহর ইতিমধ্যে দখল করে ফেলেছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনী প্রায় বিনা যুদ্ধে তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। জাতিসংঘের আফগান নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষক দল গত জুন মাসে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন বলছে, তালেবান এখন আফগানিস্তানের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্রকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং শহরাঞ্চলের বাইরে ৭০ শতাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

তালেবানের জয়ধ্বনি ইতিমধ্যে গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২০ জুন তালেবান উত্তর আফগানিস্তানে সরকারি বাহিনীকে ঘিরে ফেলে এবং দেশটির ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর কান্দুজ দখলে নেয় (কান্দুজের জনসংখ্যা তিন লাখ)। এরপর ২২ জুন তারা আফগান-তাজিক সীমান্তের শের খান বন্দর বিনা যুদ্ধে দখল করে নেয়।

এদিকে তাজিকিস্তানের সীমান্তরক্ষীরা জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে আসা ১৩৪ জন আফগান সেনা সে দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আফগানিস্তানের শর্তেপা জেলায় তালেবানের আক্রমণের শিকার হয়ে আরও ৫৩ জন আফগান সীমান্তরক্ষী সৈন্য ও স্থানীয় সৈন্য উজবেকিস্তানে পালিয়ে গেছেন। এ ছাড়া ৫ জুলাই এক হাজারের বেশি আফগান সৈন্য বাদাখশান প্রদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তাজিকিস্তানে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান থেকে আফগানিস্তানকে বিভক্তকারী আমু দরিয়া ও পাঞ্জ নদী সম্ভবত আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তালেবান দখল করে নেবে। যেহেতু তালেবান আফগানিস্তানের এ আন্তর্জাতিক সীমানা নিয়ন্ত্রণ করবে, সেহেতু আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশিয়া এবং তারপর রাশিয়া ও ইউরোপের দিকে বড় ধরনের শরণার্থী প্রবাহের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

মার্কিন যুদ্ধচেষ্টাকে দুর্বল করার উপায় হিসেবে রাশিয়া গোপনে গোপনে তালেবানকে সমর্থন করেছিল। সেই রাশিয়া এখন মধ্য এশিয়া এবং তার বাইরে ব্যাপক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছে। একইভাবে তালেবানের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার পর চীনও এখন আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা করছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের এ আশঙ্কা বেড়েছে। তালেবানের পুনরুত্থান চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে ব্যাহত করতে পারে। পাশাপাশি চীনের পশ্চিম জিনজিয়াং প্রদেশে ইসলামি চরমপন্থীরা চীনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

খুব সম্ভবত দারিদ্র্য, গণ–অভিবাসন ও গভীর অস্থিতিশীলতার উৎস হয়ে উঠবে আফগানিস্তান। আর মধ্য এশিয়ার সরকারগুলো এসব সমস্যার প্রথম সারিতে থাকবে। তারপরও অনেক আঞ্চলিক কর্মকর্তা আশ্চর্যজনকভাবে আশায় বুক বেঁধে আছেন। সম্প্রতি আফগানিস্তান ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন উজবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ কামিলভ। সেখানে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তালেবানসহ কেবল আফগানরাই আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমরা আশাবাদী, কারণ ইতিমধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেছে।’ প্রথমত, ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম দুটি পক্ষ সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেছে। তালেবানও চায় সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে।

কামিলভের মতো একজন ঝানু কূটনীতিকের মুখ থেকে এ–জাতীয় মধুর মধুর কথা বিশ্বাস করা একটু কঠিনই বটে। আফগানিস্তানকে মধ্য এশিয়ার অর্থনীতিতে আরও গভীরভাবে একীভূত করা উচিত এই যুক্তিতে তিনি হয়তো এমন কৌশল নিয়েছেন। এতে করে তালেবানও নতুন করে ‘বৃহত্তর মধ্য এশিয়া’ ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হবে, যা বিখ্যাত সিল্ক রোডের (১১০০-১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) গৌরবময় বছরগুলোর অর্থনৈতিক গতিশীলতা আবার ফিরিয়ে আনতে পারে।

চীন ইউরেশিয়াজুড়ে তার বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত সম্পর্ক আরও গভীর করতে বদ্ধপরিকর। চীনের এ দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সবার আগে দরকার আফগানিস্তানে শান্তি।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • দজুমার্দ ওতোরবায়েভ কিরগিজস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী