আবদুল মতিন খসরু: বিজ্ঞ, উদার ও বড় মনের আইনজীবী

সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু
ছবি প্রথম আলো

মাসখানেক আগে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক নির্বাচন হয়েছিল। আবদুল মতিন খসরু সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলেন। বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর। নির্বাচনের কয়েক দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ এপ্রিল চিরতরে চলে গেলেন।

নির্বাচনে ভোট দিতে যাইনি। ভোটের দুদিনই ভোটকেন্দ্র ও তার আশপাশে সঙ্গনিরোধের বালাই ছিল না। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনের দুদিনে একটা অদ্ভুত রীতি গড়ে উঠেছে। কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য থেকে সভাপতি পর্যন্ত সব প্রার্থীকে ভোটকেন্দ্রের দরজা থেকে দুই পাশে দুই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভোটারদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রার্থীদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে ভোটকেন্দ্রের দরজা পর্যন্ত যেতে হয়। প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে ভোটারদের হাতে তাদের ব্যালট নম্বরের কাগজ গুঁজে দেন। ভোট দেওয়ার জন্য তাঁদের শেষ মুহূর্তের অনুরোধ, কাকুতি-মিনতি। প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকেন ভোটদানের পুরো সময়টা, পরপর দুদিন।

আমার এক সহকর্মী ভোটের পর আমাকে বলেছিলেন, ‘মতিন খসরু স্যারকে খুব ফ্যাকাশে আর দুর্বল দেখাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যে পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়ছিলেন আর নতুন ভোটার এলেই বারবার উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন।’

স্বাস্থ্যবিধিবিহীন এ নির্বাচন তাঁর মৃত্যু ডেকে এনেছিল কি না, এই প্রশ্নে আমরা শুধু জল্পনাই করতে পারি। কিন্তু এ ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর বিতৃষ্ণা ও রাগ তো চেপে রাখা দুষ্কর। বয়স্ক প্রার্থীদের এত লোকের ভিড়ে আর মার্চের গরমে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পরপর দুদিন দাঁড় করিয়ে রাখার শাস্তি ও নির্যাতনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।

তার থেকেও কঠিন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা বারের একটা অদ্ভুত নিয়মের আওতায় সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে ভোটাধিকার দেওয়া।
আবদুল মতিন খসরু পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। জীবনে আরও নির্বাচনে জিতেছেন, কিন্তু হয়তো তাঁর সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচনে সভাপতি পদে জয়ী হওয়াটা আমাদের সবার জন্য একটা হৃদয়বিদারক ঘটনায় পরিণত হয়ে গেল। অনেক ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন তিনি।


১৯৯৬ সালের কথা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। সেবার আবদুল মতিন খসরু আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন (প্রথমে প্রতিমন্ত্রী এবং পরে পূর্ণ মন্ত্রী)। আমি বহু বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে এনজিও সেক্টরে তখন জড়িয়ে গেছি। সে সময়ে আইন ও মানবাধিকারবিষয়ক এনজিও ছিল হাতে গোনা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে টেলিফোনে বার্তা এল মতিন খসরু এনজিও কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য আইন ও সালিশ কেন্দ্রে আসবেন। যথাসময়ে হাজির হলাম। পুরানা পল্টন লেনে আসকের অফিস, দোতলায় একটা মাঝারি রুমে মাদুর বিছানো। কয়েকটা বর্গাকৃতির বালিশ মাদুরের ওপরে এখানে–সেখানে ছড়ানো। মতিন খসরু যথাসময়ে এলেন। খুব সহজভাবেই মাদুরের ওপর বসে পড়লেন। তাঁর অনাড়ম্বর, সহজ ও খোলামেলা কথাবার্তায় আমরা দু-চার মিনিটেই অনুধাবন করেছিলাম যে এই মন্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা যায় এবং তা–ই হয়েছিল।

পরবর্তী অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, অন্তত কিছু মন্ত্রীর মুখের ও অন্তরের কথা ভিন্ন, কিন্তু মতিন খসরু সেই ধরনের মন্ত্রী ছিলেন না। মন্ত্রী মতিন খসরুর সঙ্গে পরে বেশ কয়েকবার কথাবার্তা, আলাপ–আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল খোলা মনে। মুখ আর অন্তরের ফারাক ছিল না তাঁর। সমালোচনা গ্রহণ করতেন হাসিমুখে।

জাতীয় আইন সহায়তাবিষয়ক আইন প্রণয়নের আগে আইন সহায়তাবিষয়ক এনজিও কর্মীদের বার দুয়েক ডেকেছিলেন মতবিনিময়ের জন্য। আরও গোটা দু-তিনটি আইনের ব্যাপারে সংসদীয় কমিটি থেকেও ডাক পেয়েছিলাম আমরা অনেকেই।
নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের প্রস্তুতি পর্বে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার একটা প্রথা উনি চালু করেছিলেন।

পরবর্তীকালে অবশ্য এটা বজায় থাকেনি। তাঁর এই উদারতা প্রতিফলিত হয়েছিল বিচারপতি নিয়োগেও। আবদুল মতিন খসরুর সময়ে বিভিন্ন মত ও পথের আইনজীবীরা বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁর পর থেকে কোনো আইনমন্ত্রীর আমলে ভিন্নমতের কোনো আইনজীবী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে তো মনে পড়ে না। সুপ্রিম কোর্টে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানার নিয়োগ হয়েছিল ২০০০ সালে, অর্থাৎ মতিন খসরু আইনমন্ত্রী থাকাকালে।


দুই দশকের বেশি সময় গড়িয়েছে, সম্ভবত দুবার তাঁর সঙ্গে আমার বিদেশে আইনবিষয়ক কনফারেন্সে একসঙ্গে যাওয়া হয়েছিল। একসঙ্গে এ অর্থে যে মতিন খসরু গিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে, আর এই অধমের অংশগ্রহণ ‘ঝগড়াটে এনজিও কর্মী’ হিসেবে।

একবার তো কনফারেন্সে ঝগড়াই বাধিয়ে দিলাম। কনফারেন্সের পর একসঙ্গে বসে চা-কফি খেয়েছিলাম। উনি আমার সমালোচনার কারণগুলো আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। কোনো মন্ত্রীর মুখের ওপর এ ধরনের সমালোচনা করার যুগ গত হয়েছে সম্ভবত অনেক বছর।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এখনকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দক্ষিণ দিকে রাস্তার অপর পাশে দোতলা একটি বিল্ডিংয়ে সরকারের আইনসংক্রান্ত একটি অফিস ছিল। মাঝেমধ্যে বিকেল পাঁচটার পর সেই অফিসে ডাক পড়ত প্রয়াত বিচারপতি নাঈমুদ্দীন আহমেদ আর এই অধমের। নাঈমুদ্দীন স্যার তখন সদ্য স্থাপিত ল কমিশনের সদস্য ও অস্থায়ী চেয়ারম্যান। আলোচনার বিষয়বস্তু থাকত আইনমন্ত্রীর বিদেশে কনফারেন্সে বক্তব্য। অনেক সময় বক্তৃতার মুসাবিদা তৈরি করে দিতে হতো। মাঝেমধ্যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তৈরি করা খসড়া আমরা কাটাছেঁড়া করতাম। অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্রী তা মেনে নিতেন।

আবদুল মতিন খসরুর এই উদারতা ও বড় মনের সঙ্গে গত ২০ বছরে পরিচিত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাজারো বিজ্ঞ আইনজীবী। ২০ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় হন্তদন্ত হয়ে এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে দৌড়ানোর ফাঁকে সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, হাসিমুখে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, খোঁজখবর নেওয়া—সবই করতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। আমরা সবাই জেনেছি ও বুঝেছি, ‘দম্ভ’ শব্দটি তাঁর ব্যক্তিগত অভিধানে কখনো স্থান পায়নি।

লকডাউন শেষ হবে, আমরা সবাই সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যাব, বারান্দা দিয়ে হাঁটব, কিন্তু আবদুল মতিন খসরুর সঙ্গে আর দেখা হবে না। এই দুঃখের উপশম হতে সময় লাগবে অনেক।

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক