আবারও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা কেন

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জ্বালানি তেলের মূল্যহার বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে বছরের পর বছর অবৈধ উপায়ে বৃদ্ধি করে আসছে। দিনে ১০০ কোটি টাকা ভতুর্কি কমানোর অজুহাতে আবারও তারা ডিজেল, পেট্রোল তথা জ্বালানি তেলের মূল্যহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্ত যেকোনো দিন রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এতে পরিবহনভাড়াসহ ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় শত শত কোটি টাকা বাড়বে। সেই ভাবনায় ভোক্তারা এখন রীতিমতো আতঙ্কিত ও দিশেহারা।

জ্বালানি তেলের মূল্যহার বৃদ্ধিতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং ভোগ ব্যয় কমবে। ফলে বাজারে পণ্য ও সেবার চাহিদা হ্রাসে সরকার যথেষ্ট পরিমাণে আয় হারাবে, বাজেট ঘাটতি বাড়বে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশান (বিপিসি) কর্তৃক মূল্যহার বৃদ্ধি কিংবা মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসির পরিবর্তে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে পাঠানো এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কর্তৃক মূল্যহার বৃদ্ধি কোনোটিই যেমন বৈধ নয়, তেমন মূল্যহার বৃদ্ধির পরিমাণও ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়।

বিভিন্ন মহল দীর্ঘদিন ধরে বিপিসির আয়-ব্যয় হিসাবের আন্তর্জাতিক অডিট দাবি করে আসছে। এলপিজিসহ সব পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ তথা ডিজেল, পেট্রোল, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল ইত্যাদির মূল্যহার বিইআরসি আইনের ২২ ও ৩৪ ধারামতে নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসির। ২৭ ধারামতে, বিপিসি বিইআরসির লাইসেন্সি। ৩৪ (৬) ধারামতে, উক্ত যেকোনো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি/পরিবর্তনের প্রস্তাব লাইসেন্সি হিসেবে বিপিসিকে বিইআরসির কাছেই পেশ করতে হবে এবং ৩৪ (৪) ধারামতে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষদের শুনানি দেওয়ার পর বিইআরসি মূল্য নির্ধারণ করবে। সে আইন অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যহার বিইআরসি নির্ধারণ করে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে এলপিজির মূল্যহার বিইআরসি আইনের আওতায় এখন বিইআরসি কর্তৃক নির্ধারিত হয়। এতে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে লাইসেন্সিরা সিলিন্ডারপ্রতি কমপক্ষে গড়ে দেড় শত টাকা বেশি নিয়েছে। ভাবলে অবাক হতে হয়, এক যুগের বেশি সময় ধরে ভোক্তাদের কাছ থেকে কত কোটি টাকা এলপিজি কেনা–বেচায় লুণ্ঠন হয়েছে! পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ তথা তরল জ্বালানির মূল্যহার বিইআরসি কর্তৃক শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে জানা যেত, লিটারপ্রতি বাড়তি কত টাকা বিপিসি বেশি নিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন মূল্যহারে সমন্বয় না করে ৪৩ হাজার কোটি টাকা বিপিসি রাজস্ব চাহিদার অতিরিক্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধি মূল্যহারে সমন্বয়ের অজুহাতে আরও কত কোটি টাকা ইতিমধ্যে ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি নিয়েছে, গণশুনানি হলে তা–ও জানা যেত। কিন্তু বিপিসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সেসব তথ্য গোপন রাখতে চায়। কিন্তু কেন? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জনসেবার এ কেমন দৃষ্টান্ত ও ঔদ্ধত্য ? রহস্য ও সন্দেহ সেখানেই।

আইনি বিবেচনায় বলা যায়, চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে ভোক্তারা মূল্যহার বৃদ্ধির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পায় এবং লুণ্ঠনমূলক মূল্যহার বৃদ্ধি প্রতিরোধে সোচ্চার হতে পারে। জ্বালানি তেলে তা না হওয়ায় ভোক্তা সে সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা ও বিনিয়োগ ব্যয় তথা অবচয় ব্যয়/ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় বিইআরসি আইনের ধারা ৩৪ (২)-এর পরিপন্থী এবং প্রতিযোগিতা আইনের ধারা ১৫ ও ১৬ অনুযায়ী লুণ্ঠনমূলক। বিইআরসি (বিদ্যুৎ উৎপাদন ট্যারিফ) প্রবিধানমালা, ২০০৮–এর ৫ ধারায় বর্ণিত বিধানাবলিমতে, উল্লিখিত লুণ্ঠনমূলক ব্যয় মূল্যহারে সমন্বয় করা বা না করার একক এখতিয়ার বিইআরসির। বিইআরসি আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন ওই আ্ইনের ৪২ ধারামতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিইআরসির মানদণ্ডে লাইসেন্সি কিংবা বিনিয়োগকারীর জন্য মার্জিন বা মুনাফা এবং ইক্যুইটি ও ঋণের ওপর সুদ কোনোটিই ৫ শতাংশের অধিক নয়। বিইআরসি নির্ধারিত মানদণ্ড অপেক্ষা অধিক মুনাফা ও সুদ উভয়ই লুণ্ঠনমূলক।

তাই ওই আইনি বিবেচনায় বলা যায়, চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারিত হলে ভোক্তারা মূল্যহার বৃদ্ধির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পায় এবং লুণ্ঠনমূলক মূল্যহার বৃদ্ধি প্রতিরোধে সোচ্চার হতে পারে। জ্বালানি তেলে তা না হওয়ায় ভোক্তা সে সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

আরও পড়ুন

আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ে লাইসেন্সিরা গ্যাসে ১১৭ শতাংশ ও বিদ্যুতে ৭৯ শতাংশ মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। কিন্তু গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়, চলতি বছরে গ্যাসে ঘাটতি ১৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৬২ শতাংশ। অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এমন ব্যয় রাজস্ব চাহিদায় অন্তর্ভুক্ত না করা হলে গ্যাসে ভর্তুকি হ্রাস পায় এবং মূল্যহার বৃদ্ধি হয় না। আবার অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বিদ্যুতে চলতি বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সে ব্যয় বিদ্যুৎ উৎপাদন রাজস্ব চাহিদায় অন্তর্ভুক্ত না করা হলে বিদ্যুতে আর্থিক ঘাটতি থাকে না এবং মূল্যহার বৃদ্ধি নয়, বরং কমানো যায়। জ্বালানি তেলকে চুরি এবং অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় মুক্ত করতে হলে দরকার বিইআরসি আইনমতে মূল্যহার যথাযথভাবে নির্ধারণ করা এবং সেই সঙ্গে লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসনকে আমলামুক্ত করা।

জ্বালানি খাতের আপস্ট্রিম রেগুলেটর বিধায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বা পরিচালক কোনো পদই গ্রহণ করতে পারেন না। অর্থাৎ তাঁরা লাইসেন্সি বা লাইসেন্সির প্রতিনিধি হতে পারেন না। অথচ তাঁরা লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ডে কেউ চেয়ারম্যান ও কেউ পরিচালক, অর্থাৎ লাইসেন্সি প্রশাসন পরিচালনায় শীর্ষ ব্যক্তিরা। ফলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ স্বার্থের সংঘাতে যুক্ত এবং লাইসেন্সিদের আপস্ট্রিম রেগুলেটর হিসেবে অকার্যকর। ভোক্তা স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষণে তাঁদের ভূমিকা সাংঘর্ষিক।

এখানে বলা দরকার, ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে সমুদয় ফার্নেস অয়েল বিপিসির মাধমে আমদানি করা হলে সাশ্রয় হতো প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। আমদানি পর্যায়ে ফার্নেস অয়েলে শুল্ক ও করাদি অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার কর না হলে সাশ্রয় হতো প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। বিইআরসির মানদণ্ডমতে, বিপিসির মার্জিন বা মুনাফা ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ নির্ধারিত হলে তাতে কত কোটি টাকা সাশ্রয় হতো, সে হিসাব পাওয়া যায়নি। যখনই জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় বাড়ে, তখন শুল্ক-ভ্যাট-করাদি এবং বিপিসির মুনাফার পরিমাণও বাড়ে। তা নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার বৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক করার মতো কোনো বিবেচনায় বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের বিবেচনায় থাকে না। অর্থাৎ মূল্যহার নির্ধারণে জনস্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার মতো মৌলিক বিষয় উপেক্ষিত এবং সরকারের জনকল্যাণমূলক আদর্শের পরিপন্থী।

আরও পড়ুন

রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের মূল্যহার নির্ধারণে তিন কর্তৃপক্ষীয়/নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, বিইআরসি ও বিপিসি আইন লঙ্ঘন এবং বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে বেপরোয়া। ফলে জ্বালানি খাতে আইনের শাসন অচল। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তা অধিকার ভয়ানকভাবে বিপর্যস্ত। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিবর্তন জরুরি। সে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জ্বালানি বিভাগ/বিপিসির পরিবর্তে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, কেরোসিনসহ সব পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের মূল্যহার পবিবর্তন/সমন্বয় তথা হ্রাস/বৃদ্ধি স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষদের শুনানির ভিত্তিতে বৈধভাবে বিইআরসি কর্তৃক নিশ্চিত করা; কম্পটোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল দ্বারা আমদানিকৃত তরল জ্বালানি ক্রয়সংক্রান্ত তথ্য নিবিড় পর্যালোচনা করা; জ্বালানি খাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে লাইসেন্সিদের পরিচালনা বোর্ড তথা প্রশাসন থেকে জ্বালানি বিভাগসহ সব মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তাকে অবমুক্ত করা। এই কর্মকর্তাদের দ্বারা লাইসেন্সিদের কাছ থেকে গৃহীত আর্থিক সুবিধাদি অবৈধ বিধায় গৃহীত সমুদয় অর্থ তাদের কাছ থেকে আদায় করা এবং বিইআরসি আইন লঙ্ঘন করে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনের মূল্যহার নির্ধারণের দায়ে বিপিসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিইআরসি আইনের ৪২ ধারামতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

  • এম. শামসুল আলম জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব