আবারও নতুন মেডিকেল কলেজ?

কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী দেশে আরও ১১টি মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন করলেন। এর ভেতর পাঁচটি সেনাবাহিনী পরিচালিত আর বাকি ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ। একই সঙ্গে শোনা গেল সরকারের প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে মেডিকেল কলেজ এবং বিভাগীয় শহরে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের এ পদক্ষেপ গ্রহণকে অনেকেই সমর্থন করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় এ নিবন্ধ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ওপর আলোকপাতে সীমাবদ্ধ থাকবে।
আমাদের দেশে বর্তমানে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা কত? এ প্রশ্ন শুনে সহজেই কেউ জবাব দিতে পারবেন না। বছরান্তে এ সংখ্যা পরিবর্তিত হচ্ছে। পাকিস্তানের শুরুতে ছিল কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরবর্তী সময়ে দুটি যোগ হয়ে তা দাঁড়ায় তিনে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাড়াও এই দলে ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ। পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ ও সিলেটে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। শেষ সংযোজন ঘটে রংপুর, বরিশাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু ৮ মেডিকেল কলেজ নিয়ে। এরপর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে স্থানভেদে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা ২৯। আর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে পাঁচটি সংযোজিত হয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াল ৩৪-এ। আমরা যদি পাশের দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব জনসংখ্যা ও আয়তনের নিরিখে উপমহাদেশে সংখ্যাগত দিক থেকে আমরা এগিয়ে রয়েছি। আমাদের এই দেশে রয়েছে ৫৮টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। তার সঙ্গে ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে শক্ত সম্পর্কের সুবাদে এ সংখ্যা অচিরেই বেড়ে দাঁড়াবে ৬৯-এ।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ১২টি ও বেসরকারি একটি। উত্তর প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের কয়েক গুণ বড়। জনসংখ্যার দিক থেকেও ওই রাজ্যের অবস্থান আমাদের ওপরে। উত্তর প্রদেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা নয়টি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা পাঁচ অর্থাৎ মোট সংখ্যা ১৪। আমরা যদি ভারতের এই দুটি রাজ্যের মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার মানের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি তাহলে গর্ব করার মতো তেমন কিছু পাব না। গবেষণার দিক থেকেও আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
আমাদের দেশে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী? লক্ষ্যই বা কী? বাংলাদেশে চিকিৎসকের সংখ্যা কি অপ্রতুল? পরিসংখ্যানের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে তা অপ্রতুল বলে মনে হয় না। বর্তমানে প্রতি বর্গমাইলে একজন করে এমবিবিএস ডাক্তার রয়েছেন। প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে চার সহস্রাধিক ডাক্তার পাস করে বেরোচ্ছেন। অর্থাৎ পাঁচ বছরের মাথায় প্রায় লাখের কাছাকাছি পৌঁছাবে।
আমাদের দেশে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার পরিবেশ কি সন্তোষজনক? ঢাকা মহানগরের বাইরের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর চিত্র অবশ্যই সন্তোষজনক নয়।
মেডিকেল কলেজগুলোতে রয়েছে শিক্ষকসংকট। তার ওপর দলীয় রাজনীতির প্রভাবহেতু শিক্ষকদের ভেতর একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজমান। নব্বইয়ের দশক থেকে মেডিকেল শিক্ষাঙ্গনে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষকদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়। এ ধারা বজায় থাকার ফলে জুনিয়র সিনিয়রকে ডিঙিয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। এমনকি ছাত্রও শিক্ষককে ডিঙিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে অবস্থান করতে পারেন।
মেডিকেল কলেজগুলোতে কর্মরত শিক্ষকেরা নিয়মিত অবস্থান করে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন না। ফলে ছাত্র–শিক্ষকের ভেতর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠছে না, যা মেডিকেল শিক্ষার মতো প্রফেশনাল শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ছাত্রদের সামনে শিক্ষকের আদর্শিক অবস্থান নিরন্তর প্রশ্নের সম্মুখীন। ঢাকার বিভিন্ন প্রাইভেট চেম্বার ক্লিনিক এমনকি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ভিজিটিং শিক্ষকের তালিকায় দেখা যাবে মফস্বলে পদায়নকৃত সরকারি শিক্ষক চিকিৎসকের নাম।
শিক্ষকদের এ অবস্থানের পাশাপাশি রয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ত্রুটিপূর্ণ অবস্থান। মেডিকেল কলেজগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয় ঠিকই কিন্তু এসবের মানে যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের সংকট। শিক্ষক ও যন্ত্রপাতির সমান্তরাল অবস্থানহেতু প্রশিক্ষণে ঘাটতি নিয়েই শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসছেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। কয়েকটি মেডিকেল কলেজ বাদে অধিকাংশ মেডিকেল কলেজে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নেই, মানসম্পন্ন হাসপাতাল নেই, সর্বোপরি রয়েছে একাডেমিক কাজের জন্য রোগীর সংকট। ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলো মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন সরকারি মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তীর্ণ এমবিবিএস চিকিৎসকেরা পরিবেশ পরিস্থিতিগত কারণে দুর্বল থাকে।
মোট কথা, বিদ্যমান অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো থেকে বেরিয়ে আসা, পাস করা ডাক্তারদের পেশাগত মান দুর্বল থাকছে। এর ফলে জনস্বাস্থে্য বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দক্ষ চিকিৎসকের অভাবের পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে সাধারণ মানুষ অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন।
এমতাবস্থায় নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি। আমাদের শিক্ষার মান যদি ভালো হতো, আমাদের ডাক্তারদের বহির্বিশ্বে যদি চাহিদা থাকত, তাহলে অবশ্যই তা সমর্থনযোগ্য হতো। বহির্বিশ্বে চিকিৎসকদের যে চাহিদা রয়েছে, তাতে আমাদের অংশগ্রহণ করতে হলে অবশ্যই মানসম্পন্ন ডাক্তার তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন বিদ্যমান মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কেবল নিজের এলাকায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে সরকারপ্রধানকে বিব্রত না করে প্রয়োজন তাঁকে সহযোগিতা করা। চিকিৎসক নেতাদের ইতিবাচক দূরদর্শী ভূমিকা প্রয়োজন। আমার স্থির বিশ্বাস, সরকারপ্রধানকে দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করলে হয়তো এ পর্যায়ে নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসত না।
মো. শফিকুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।