আবাসিক এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার

রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থাপনায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় l ফাইল ছবি
রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থাপনায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় l ফাইল ছবি

আমরা কি আইন মানতে চাই? নাকি আইন না মানতে মানতে একধরনের শক্তি অর্জন করেছি যে সর্বোচ্চ আদালতের আইনও মানব না? গত কয়েক বছরে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটা প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই এলাকায় মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে অনেকগুলো স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি স্থাপনা। এই সব স্থাপনা ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় একটা বড় উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রকট যানজটসহ বাসিন্দাদের নানা ধরনের সমস্যা। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। বনানী, গুলশান, উত্তরার ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ধানমন্ডি দেশের প্রথম আবাসিক এলাকা। একটি আদর্শ আবাসিক এলাকাও বটে। প্রচুর রাস্তাঘাট, লেক, স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান, সবই ছিল সেকালের ডিআইটির নকশায়। সেই নকশা একেক সময়ের ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে ও মদদে লঙ্ঘন করা হয়েছে। একসময় তো ধানমন্ডিকে একটি আধা-বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত প্রায় হয়েই গিয়েছিল। অবশ্য সেটা ঘটিয়ে ফেলার সময় পাননি ক্ষমতাধরেরা, সরকারে পালাবদলের কারণে।
কিন্তু ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দাপট তো বন্ধ হয়নি। ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, ক্লিনিক, রেস্তোরাঁ, আরও কত না বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে সরগরম হয়ে উঠল ‘ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা’। এমনকি ফুটপাতের ওপরও বসে হাটবাজার। কত যে কমিউনিটি সেন্টার গড়ে উঠেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাদের বাজানো শব্দযন্ত্রের উচ্চকিত কোলাহলে এই ‘আবাসিক’ এলাকার বাসিন্দাদের অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। ছোট্ট এই ধানমন্ডিতে ৫১টি স্কুল, একটি স্কুলের ১৩টি শাখা, বিশ্ববিদ্যালয় অনেকগুলো। অধিকাংশ স্কুলের খেলার মাঠ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই ক্যাম্পাস। কিন্তু আছে তাদের মধ্যে অনেক খাবারের দোকান। সবগুলোর খাবার মানসম্মত—এমন কথাও বলা যাবে না।
আমি একটি গ্রামের স্কুলে পড়েছি। ওপরে টিনের চালা ছিল কোনো রকম, বাতার বেড়া, বৃষ্টিতে পানি পড়ত। কিন্তু সামনে ছিল একটা বড় খেলার মাঠ। বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে ক্লাসে ঢুকতাম। গায়ের গরমেই জামাকাপড় শুকিয়ে যেত। তারপর ক্লাস শেষে বৃষ্টিতে ভিজে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরতাম।
আজ এই শহরের ইংরেজি মাধ্যমের অধিকাংশ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ রকম অভিজ্ঞতা আছে? বাংলা মাধ্যমেরও কি বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোতে খেলাধুলা করার সুযোগ আছে? দেশের অন্যত্র অধিকাংশ সরকারি ও কিছু বেসরকারি বিদ্যালয়-কলেজ খেলার মাঠ আছে। অভাব শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানে শিক্ষকদের কার্পণ্য। ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিং করানোর প্রতি আগ্রহের সীমা নেই। ধানমন্ডি একটি শিক্ষা বাণিজ্যের জায়গা হয়ে উঠেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও গড়ে উঠেছে অজস্র কোচিং কেন্দ্র। কিছু কিছু সড়কে সন্ধ্যার পর শত শত গাড়ি অবৈধভাবে পার্ক করে রাখা হয়। উচ্চবিত্তের চার-পাঁচটি গাড়ির মধ্যে একটি গাড়ি স্কুল ও কোচিং ডিউটির জন্য বরাদ্দ। অভিভাবকেরা সন্তানদের স্কুল আর কোচিংয়ের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন কিন্তু নিজেদের সময় ব্যয় করেন না। এমন মা-বাবাও আছেন, ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও কোনো খোঁজখবর করেন না। হয়তো একদিন দেখা যায় ছেলের মৃতদেহ পড়ে আছে; তখন নিজেদের ব্যর্থ পিতামাতা ভেবে সন্তানের লাশও আনতে যান না।
ধানমন্ডি এলাকা থেকে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলো তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে অভিভাবকেরা বড়ই উদ্বিগ্ন। ধানমন্ডির প্রভাবশালী অভিভাবকদের এখন দাবি হচ্ছে স্কুলগুলো এখানেই থাকুক, কারণ তাদের বাড়িঘর কাছাকাছিই। আবাসিক এলাকার আবাসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁরা ভাবিত নন, তাঁদের নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভাবেন: ছেলে বা মেয়ের স্কুলটা দূরে স্থানান্তর করা হলে তাঁরে অসুবিধা! এঁরা এতই ক্ষমতাবান যে সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা পাল্টে দিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা এবার বেকায়দায় পড়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা আসার ফলে।
কী অদ্ভুত বিষয়, গণমুখী কাজে নাগরিকেরা গণতান্ত্রিক সরকারকে সহযোগিতা করেন না। মোটরসাইকেলে তিনজন উঠবে, রিকশায় তিনজন, নো-পার্কিংয়ের জায়গায় পাড়ি পার্কিং করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করবে। এমনকি একেবারেই উল্টো পথে গাড়ি চালাবে! কিন্তু যখন সামরিক আইন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকে তখন সব ঠিকঠাক! তাই তো সবচেয়ে ভালো ট্রাফিক আইন চলে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়।
ধানমন্ডির অধিকাংশ বেসরকারি বিদ্যালয়ই ইংরেজি মাধ্যমের। একটি স্কুল ইতিমধ্যেই আশুলিয়ায় স্থানান্তর করেছে। বাংলা স্কুলের মধ্যে নালন্দা অচিরেই কেরানীগঞ্জ চলে যাচ্ছে। বড় স্কুলগুলোর প্রজ্ঞাবান বিবেচক শিক্ষকেরা কেন স্থানান্তরের কথা ভাবছেন না? আর একটা কথা, ইংরেজি মাধ্যমের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে বাংলা শেখানোয় আগ্রহ নেই। কিন্তু পৃথিবীতে কবে কোন জাতি মাতৃভাষা ত্যাগ করে পরভাষায় শিক্ষিত হয়েছে? ইংরেজির জন্য কোচিং–বাণিজ্যও রমরমা। এই ব্যবস্থায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে সন্তান চলে যাচ্ছে দূরে। উচ্চবিত্ত অভিভাবকেরা ভাবছেন তাঁদের সন্তানদের এ দেশে কোনো কাজ নেই। তাঁরা সন্তানদের পাঠাবেন বিদেশে। তাই ইংরেজি স্কুল-কলেজে সন্তানদের পড়ানোর এত তোড়জোড়। কিন্তু এই সব মানুষের জন্য ধানমন্ডি এত ত্যাগ স্বীকার করবে কেন?
আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তরের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য নাগরিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আবাসিক এলাকাগুলো থেকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড স্থানান্তর করে মানুষের বসবাসের সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। কোনো ধরনের অন্যায্য প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ রাখা চলবে না। সরকারের এই গণমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পক্ষে যখন সর্বোচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা এসেছে, তখন সংকীর্ণ স্বার্থ ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে সব নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সমর্থন ও সহযোগিতায় ধানমন্ডি, বনানী, উত্তরা, গুলশান প্রভৃতি আবাসিক এলাকায় আগের সেই আবাসিক রূপ ফিরে আসুক।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।