আবু গারিবের স্মৃতি মনে রাখার দায় পড়েছে কার

বাগদাদে আবু গারিব কারাগারে মার্কিনিদের বন্দী নির্যাতনের ছবি নিয়ে তেহরানের একটি প্রদর্শনী। জুন, ২০০৪
ফাইল ছবি: এএফপি

আবু গারিবের কথা কে মনে রেখেছে? আমরা কেন আবু গারিবের কথা মনে রাখব? আবু গারিব সাম্রাজ্যবাদী বিজয়ের একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করে। এই যুগের শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে ইরাকে আর আফগানিস্তানে ২০০১ সালে। আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহারের পর এখন আর আবু গারিবের কথা মনে রাখার কোনো কারণ নেই আমেরিকার। আবু গারিব একটা কারাগার। বাগদাদের কাছে এই নামে একটি শহরে কুখ্যাত কারাগারটির অবস্থান।

সাদ্দাম হোসেন বহু বছর ধরে ভিন্নমতাবলম্বী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অবৈধভাবে বন্দী ও নিপীড়নের জন্য কারাগারটি ব্যবহার করতেন। কারাগারটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আমেরিকাও একই কাজ শুরু করে। ধর্ষণসহ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার মতো নির্যাতন সেখানে চলত। সাদ্দাম হোসেন নাকি জর্জ ডব্লিউ বুশ, যাঁর হাত দিয়েই অনুমোদন হোক না কেন, বন্দীদের ওপর এই নৃশংসতার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু সাদ্দাম আর যা-ই হোক, কখনো নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবি করেননি। বুশ এবং তাঁর মতো প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সেই দাবি আমাদের শুনতে হয়েছে। যা-ই হোক, বিশ্বকে ‘আমেরিকান মূল্যবোধের’ ক্লান্তিকর সবক সহ্য করতে হয়।

আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের পর ২০০৪ সালে মার্কিনিদের হাতে বন্দী নির্যাতনের বেশ কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু আবু গারিব কারাগার নয়; গুয়ানতানামো বে এবং আফগানিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী নির্যাতনের ছবি ছিল সেগুলো। বন্দীদের বন্ধু ও পরিবারের কাছে পাঠানোর জন্য তোলা হয়েছিল ছবিগুলো। মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সন্ত্রাস আরও বাড়িয়ে তুলতেই তারা সেটা করেছিল। এই ছবিগুলো শিগগিরই আমেরিকান নৈতিক পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

আমেরিকানরা বন্দীদের নির্যাতন, তাদের অঙ্গহানি ও খুন করত। বিকৃত যৌনতায় তাদের বাধ্য করত। ওই লোকগুলো কীভাবে এই কুৎসিত কাজ করত? শিগগিরই বিশ্ব মিডিয়া ছবিগুলো ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। চার্লস গ্রানার, লিন্ড ইংল্যান্ড, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জানিস কারপনস্কির নাম আবু গারিব নির্যাতনকেন্দ্রের ভয়াবহতার সমার্থক হয়ে উঠল। কিন্তু জর্জ ডব্লিউ বুশ, ডিক চেনি, ডোনাল্ড রামসফেল্ডের মতো নামগুলো ‘মুক্ত ভূমি ও বীরদের দেশে’ পূজনীয় ও সম্মানীয় রয়ে গেল। আমেরিকা শিগগির তাঁদের নামগুলো ভুলে গেল। তাঁদের স্মৃতিভ্রংশ অসুখ শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে নিয়ে এল। এভাবে নয়-এগারো পথ দেখাল এক-ছয়কে; এদিনে ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী অনুসারীরা আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ ও লুটপাট চালায়।

আবু গারিবের ভয়াবহ ওই ছবিগুলো প্রকাশের পর কিছু চিত্রশিল্পী ভিন্নভাবে সেগুলো আঁকতে শুরু করলেন। ড্যানিয়েল বুউতি নামের একজন সুইস শিল্পী তাঁর একটি প্রদর্শনীর নাম দিয়েছিলেন ‘ওহ বয়! ওহ বয়!’ ওই প্রদর্শনীতে তিনি ছবিগুলোকে দাগযুক্ত কাচের কারুকার্যময় শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছিলেন। এগুলো দেখতে গিয়ে লোকে বিব্রতকর এক পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। সুন্দর একটা আয়নার মধ্য দিয়ে যেন আমেরিকার নির্যাতনকেন্দ্র উঁকি দিচ্ছিল। সৌন্দর্য দেখে আমরা ভীত হব, নাকি সন্ত্রাস দেখে আমরা মুগ্ধ হব?

ইরাকি বন্দীদের ওপর চালানো আমেরিকার এই নির্যাতনের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে অতীতের আরেকটি ঘটনার। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী খুনিরা তখন গাছে ঝুলিয়ে মানুষ হত্যা করত। কিংবদন্তি জ্যাজ গায়ক বিল্লি হলিডে তাঁর সুপরিচিত গানে ওই খুনিদের নাম দিয়েছেন ‘অদ্ভুত ফল’। সেই গাছের ফলই ইরাকে রোপণ করা হয়েছিল। সেই একই বর্ণবাদী ঠগি, যারা একসময় দক্ষিণে এই বীজ রোপণ করেছিল, সেটাই তারা পুবে এসে রোপণ করে দিয়েছে।

ইরাকি শিল্পীরাও কিন্তু আমেরিকার আগ্রাসন ও আবু গারিবের নৃশংসতার ঘটনায় অলসভাবে বসে ছিলেন না। কাসিম আলসাবাতি নামের একজন শিল্পী বলেছিলেন, ‘শিল্পী হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব যে আমাদের দেশের মানুষ কী অনুভব করছে এবং কী দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা জানা ও বোঝা।’ ২০০৪ সালে তিনিসহ আরও ২৪ জন শিল্পী আবু গারিবের ঘটনার প্রতিবাদে বাগদাদে একটা চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আমেরিকা, কুয়েত, ইরাকের একদল শিল্পী নিউইয়র্কে ‘দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’ গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। কুয়েত ও ইরাকের মানুষ যেসব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, সেটার প্রতিফলন ছিল সেই প্রদর্শনীতে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এটা নিয়ে পর্যালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এটা নিয়ে জনগণের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।

বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকার গণমাধ্যমে আবু গারিবের নির্যাতনের ঘটনা পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে—এমন সংবাদ পাওয়া যাবে না। এটা করার তাদের কোনো কারণও নেই। এর বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক স্মৃতিভ্রংশের চর্চা সমৃদ্ধ করে চলেছে। সাম্রাজ্যের কাছে ইতিহাসের কোনোই মূল্য নেই।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া

হামিদ দাবাশি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক