আমরা কি টিকা তৈরি করতে পারি না?

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের উত্তরণ এখন বিশ্ব স্বীকৃত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছিল না। ১৯৮২ সালে ড্রাগ (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের ওষুধশিল্প গতি ফিরে পায়। তারপর ৩৯ বছরের ইতিহাস শুধুই সামনে যাওয়ার। ছোট-বড় মিলিয়ে এ দেশে এখন নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৭২টি। তবে নিয়মিত উৎপাদনে আছে এমন কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ১৬০টি।

বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধই এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ওষুধের গুণগত মান ভালো থাকার কারণেই ইউরোপ, আমেরিকার রেগুলেটেড মার্কেটসহ বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে আমরা ওষুধ রপ্তানি করছি। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের বিষয়। তবে ট্রেড রিলেটেড অ্যাস্পেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস)–এর বাইরে থেকে বর্তমান ওষুধশিল্প যে সুবিধা ভোগ করছে, সেটি হয়তো ২০৩২ সালের পর থাকবে না। এ কারণে এ শিল্পের বিকাশকে ধরে রাখার জন্য এখনই শক্ত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের প্রতি যেমন অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন, তেমনি নতুন ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা বিবেচনায় রেখে নতুন ধরনের ওষুধ তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত এপিআই পার্কটি পূর্ণরূপে চালু হলে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবে। পাশাপাশি অধিক মুনাফাকাঙ্ক্ষী অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন মানহীন ও নকল ওষুধ উৎপাদনের মাধ্যমে এ শিল্পের বিপর্যয় ডেকে আনতে না পারেন, সেদিকে ওষুধ প্রশাসনকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে এবং এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ সময়ে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে, সেটি হচ্ছে নতুন ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা। সারা বিশ্বে এখন অনেক জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অস্ত্র প্রোটিন ও পেপটাইডস জাতীয় ওষুধ। এগুলোর কাঁচামাল উৎপাদন, ফরমুলেশন, মান নিয়ন্ত্রণ, বিপণন, সংরক্ষণ এমনকি প্রয়োগ পদ্ধতিও আলাদা। এ জাতীয় ওষুধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ওষুধ-বিজ্ঞানীদের যে বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার, সেটি হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যাল বায়োটেকনোলজি। বর্তমানে যেসব ফার্মাসিস্ট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছুটা শিক্ষালাভ করলেও সেটি যথেষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসগুলোতে তাই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হওয়া খুবই জরুরি।

অন্যদিকে ওষুধশিল্পে বায়োটেকনোলজির মতো নতুন মাত্রা যোগ করে এ শিল্পের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য অনেক বেশি গবেষণা করতে হবে এবং কোম্পানিগুলোতে প্রয়োজনীয় গবেষণা অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। বায়োটেকনোলজি প্রোডাক্টসের উৎপাদন করতে হলে আনুষঙ্গিক আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকা বাঞ্ছনীয়। না হলে এ–জাতীয় ওষুধগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের এই অগ্রগতি মূলত সম্ভব হয়েছে জেনেরিক ড্রাগসের ফিনিশসড ফরমুলেশন তৈরির মাধ্যমে। যদিও বর্তমানে ইনহেলেশন টেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি এবং দু–চারটি বায়োলজিক্সের ফিলিং শুরু হয়েছে, এগুলোকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে হবে। এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে আমরা অতি দ্রুত যেকোনো ফরমুলেশন প্রোডাক্ট তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছি, তবে টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। টিকা তৈরির যথেষ্ট সক্ষমতা না থাকায় গত এক বছরে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনে আমরা তেমন কোনো অবদান রাখতে পারিনি।

এ ক্ষেত্রে সামনের সারির কোম্পানিগুলোর মধ্যেও তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। একটি দেশীয় কোম্পানি টিকা তৈরিতে এগিয়ে এলেও এদেশে টিকা তৈরির সমন্বিত সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে এখনো এটি যৌক্তিক গতিতে এগোতে পারছে না। এ ছাড়া তাদের সক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতাও অনেক কম।

গত এক বছরে এদেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর একটিও কোভিড-১৯ টিকা তৈরির আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সরকারি পর্যায়েও তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ গত এক বছরে অ্যাস্ট্রাজেনেকা নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করে টিকা উৎপাদন করছে। চীনের সিনোভ্যাক তাদের উৎপাদনক্ষমতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিশ্বখ্যাত সর্ববৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট থাকা সত্ত্বেও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকা তৈরিতে এগিয়ে এসেছে।

এ কথা বলা যাবে না যে এটিই শেষ মহামারি। আরও অনেক অজানা রোগ ভবিষ্যতে আসতে পারে। এসব কিছু মাথায় রেখে বড় পরিসরে বাংলাদেশে একটি টিকা তৈরির অবকাঠামো স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। সঙ্গে সঙ্গে টিকা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও স্থাপন করতে হবে।

সমস্যা থেকেই আমরা উত্তরণের পথ খুঁজে পাই। প্রাইভেট-পাবলিক সমন্বয়ে এ সময়ে বাংলাদেশে টিকা তৈরির একটি মহৎ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারত। যথেষ্ট অবকাঠামো থাকলে অন্তত অন্য দেশ থেকে টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে এ দেশে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনে আমরা অংশ নিতে পারতাম এবং দেশীয় প্রয়োজন মিটিয়ে অন্য দেশে রপ্তানির একটা সুযোগ সৃষ্টি হতো।

এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুটি প্রতিষ্ঠান মডার্না এবং বায়োএনটেক কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনের মধ্য দিয়েই তাদের সক্ষমতা এবং ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যেখানে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর আস্থা অর্জন করেছে, সেখানে এ দেশের প্রথম সারির দু–একটি কোম্পানি একটু ঝুঁকি নিয়ে কোভিড-১৯ টিকা তৈরির চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে টিকার বাজারেও বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারত।

এ কথা বলা যাবে না যে এটিই শেষ মহামারি। আরও অনেক অজানা রোগ ভবিষ্যতে আসতে পারে। এসব কিছু মাথায় রেখে বড় পরিসরে বাংলাদেশে একটি টিকা তৈরির অবকাঠামো স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। সঙ্গে সঙ্গে টিকা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও স্থাপন করতে হবে। অন্তত দেশে এই মুহূর্তে কয়েকটি বায়োসেফটি লেভেল-৩ ল্যাবরেটরি স্থাপন করা একান্ত প্রয়োজন। হাতে গোনা দু–একটি কোম্পানি সীমিত আকারে দু–একটি টিকা উৎপাদন করলেও সম্পূর্ণ টিকা তৈরির প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপিত হয়নি।

আশা করি, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আগামী দিনে টিকা এবং অধিক বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস উৎপাদনের মাধ্যমে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।

ড. হাসান মাহমুদ রেজা: অধ্যাপক ও ডিন, স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।