আমরা কি নিজেদের সভ্য দাবি করতে পারি?

একদিনের ঘটনা মনে পড়ছে। সে বড্ড তিক্ত এক অভিজ্ঞতা! যানজটে শত শত গাড়ি আটকে আছে, গাড়ির মধ্যে নাকাল হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ, অথচ ও পাশের রাস্তাটি ফাঁকা। হঠাৎ দেখতে পেলাম, একজন মন্ত্রীর গাড়ি, একজন সাংসদের গাড়ি এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তার গাড়ি নিয়ম ভেঙে সাঁই সাঁই করে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

 কী অদ্ভুত দেশ! উনারাই বঙ্গদেশের আইনপ্রণেতা, আইনের রক্ষক এবং দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও গিন্নি! আর উনাদেরও শুধু দোষ দিই কেন? অামরা কি কিছু কম যাই? দলেবলে একটু বড় হলে আমরা রাস্তা অবরোধ করে গল্প করি অথবা রাস্তাকেই বাপের জমিদারি মনে করি (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাড়া-মহল্লায় এমন দৃশ্য অনেকেই দেখে থাকবেন।) সংবিধানের মুখবন্ধ এবং ২৭ অনুচ্ছেদে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, আইনের শাসন আইনের শাসন বলে অমরা মুখে যতই ফেনা তুলে ফেলি না কেন, আমাদের রক্ত-মজ্জা ও মানসিকতায় আইনের শাসন নেই। ফলে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ডুরখেইমের ‘অ্যানোমি’ (Anomie) বা আইনহীনতাই আজ বাংলাদেশের অনিবার্য নিয়তি হয়ে গেছে।

যে সংবিধানের কথা বলছিলাম, ওই সংবিধানের শুরুতে এবং অনেকগুলো অনুচ্ছেদে মানবাধিকারের কথা বলা আছে। আর কত না সুন্দর এবং উদ্দীপনাময় ওই অনুচ্ছেদগুলোর শব্দ, বাক্য, ভাষ্য ও মর্মবাণী! কিন্তু বাংলাদেশে মানবাধিকারের বাস্তব অবস্থা কী? যাঁরা মনোযোগ দিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই মর্মাহত হয়েছেন, কেউ কেউ হয়তো অাঁতকে উঠেছেন। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সবকিছু মসৃণভাবে চলবে, কোনো দুর্ঘটনা, নির্যাতন, খুন, গুম, নারীর প্রতি নৃশংসতা থাকবে না, তা বলি না। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ কর্মকর্তারা যদি সব ফেরেশতাও হয়ে যান, তবু সমাজে নানা রকম দুর্ঘটনা, নারীর প্রতি সহিংসতা, সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর আক্রমণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে।

মানুষের সমাজে এ এক স্বাভাবিক ঘটনা, অনিবার্য অনুষঙ্গ। কেননা, পবিত্র কোরআন, ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্টে যে ‘অরিজিনাল সিন’-এর কথা বলা হয়েছে, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, দস্তয়ভস্কি এবং আরও অনেকেই প্রত্যেকটি মানুষকেই যে ‘পোটেনশিয়াল ক্রিমিনাল’ বলেছেন, এ ছাড়া মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রে যে নানা রকম কাঠামোগত ও অন্যান্য অসংগতি রয়েছে, তাতে করে মনুষ্য সমাজে অপরাধ, ‘অ্যান্টি-সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি’, মানবাধিকার লঙ্ঘন অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তারপরও বিগত বছরটিতে এমন কিছু নৃশংস, মর্মা‌ন্তিক ও নারকীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে যে যার দায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

২০১৪ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ধর্ষিতা হয়েছেন ৭০৭ জন নারী, গুম হয়েছেন ৮৮ জন, পুলিশি হেফাজতে খুন হয়েছেন ৬০ জন, ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের, রাজনৈতিক কোন্দলে মারা গেছেন ১৪৭ জন, ১ হাজার ২০১ জন হিন্দু নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং সীমা‌ন্তে খুন হয়েছেন ৩৩ জন।

একদিকে রাষ্ট্র ছাড়া যেমন মানুষের চলে না আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রের মধ্যে ​‘কোআরসিভ ফোর্স’(বলপ্রয়োগকারী শক্তি) থাকে বলে রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে বড় অপরাধী এবং মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘনকারী। আধুনিক ‘হিউম্যান রাইটস ডিসকোর্স’-এ রাষ্ট্রকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধী এবং নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলে বিবেচনা করা হয়। মানবাধিকারের তথাকথিত ‘চ্যাম্পিয়ন’ এবং সারা বিশ্বে মানবাধিকারের সার্টিফিকেট বিতরণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুয়ানতানামো বের বন্দিশিবিরে বন্দীদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ছাড়া কী-ই বা বলা যায়?

২০১৪ সালে বাংলাদেশে যে ৮৮ জন গুম হয়েছেন (এর মধ্যে ২৩ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং ৪২ জন আর ফিরে আসেননি), তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এসব গুমের জন্য র‌্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ৬০ জন, যা সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে পুলিশ আইন, ১৮৬১, পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল ১৯৪৩, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইনেও নিষেধ আছে। কিন্তু প্রতিবছর পুলিশি হেফাজতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে এ রকম নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই ঘটে না, ভারত ও পাকিস্তানেও পরিস্থিতি একই রকম বা আরও ভয়াবহ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্গুসনসহ কয়েকটি জায়গায় সাদা পুলিশ কর্তৃক নিরপরাধ কালো মানুষকে শ্বাসরোধে এবং গুলি করে হত্যা সে দেশে সম্প্রতি দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছিল।      

পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কিশোর সিং বনাম স্টেট অব রাজস্থান মামলায় (AIR 1981 SC 625) বলেছেন, ‘পুলিশি হেফাজতে একজন ব্যক্তিকে পেটানোর চেয়ে কাপুরুষোচিত এবং বিবেকহীন কাজ আর হতেই পারে না এবং একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা যখন মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে এ কাজ করেন, সেটি আমাদের সাংবিধানিক সংস্কৃতির ওপর গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।’

বাংলাদেশে ব্লাস্ট ও সাইফুজ্জামানের মামলায় হাইকোর্ট পুলিশ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। এদিকে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ পাস হলেও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু হ্রাস পাওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে গুম হয়েছেন ৮৮ জন, ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশি হেফাজতে আর ১২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে। তার মানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতেই প্রাণ হারিয়েছেন ২৭৬ জন। তাহলে এই রাষ্ট্রকে কী বলব? মানবাধিকারের লঙ্ঘনকারী না হেফাজতকারী? 

২০১৪ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর দেশের নানা জায়গায় হামলা ও আক্রমণ হয়েছে। আদিবাসীরাও বাঙালিদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো সচেতন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে। গত বছরের যে ঘটনাটি আমাকে (এবং সংবেদনশীল সব মানুষকে) বেদনার্ত ও ক্ষুব্ধ করেছে, সেটি হচ্ছে ৭০৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৬৮ জনকে হত্যা করা হয়, আর আত্মহত্যা করেন ১৩ জন। ঘটনাগুলোর দায় ব্যক্তির আর দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে না পারা এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার দায় রাষ্ট্রের।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকারসহ বিরোধী দলের (সংসদ এবং মাঠের) উভয় নেত্রী নারী হলেও আমাদের সমাজ এখনো নারীদের সম্মান করতে শেখেনি। নারী ও শিশুরা আমাদের সমাজে আদৃত নয়, নিরাপদও নয়। কী করে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করব?

শেখ হাফিজুর রহমান

সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।