আমরা কি শিশুদের কাছে অপরাধী নই

প্রতীকী ছবি

করোনা বিশ্ববাসীর জন্য একেবারে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই বাস্তবতায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা একটা গুরুতর দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষিত জাতি গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সঠিক কৌশল নির্ধারণ। আমরা আপাতত স্কুল নিয়েই ভাবি। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হতোদ্যম হয় না; তারা বন্যা, ঝড়, ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস এবং নানা রোগ-বিপর্যয় মোকাবিলা করেই বেঁচে থাকে। করোনা নতুন আরেক প্রতিপক্ষ। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো খুব বিলম্ব না করে টেলিভিশনে পাঠদান শুরু করেছে। শহরে অবস্থিত বেসরকারি স্কুলগুলো প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস চালু করেছে।

এ বিষয়ে সবার একমত হতে অসুবিধা নেই যে এসব বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষার অধিকার হিসেবে শিশুর প্রাপ্যের সামান্যই মেটে। তবে মৌলিক অধিকারের প্রথমটি তো অবশ্যই বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকলেই শিক্ষার প্রয়োজন। সেদিক থেকে জরুরি বার্তা হলো, কোভিড-১৯ সম্পূর্ণ বন্ধ হবে না, মৌসুমি ফ্লুর মতো এটি নিজে থেকে প্রশমিত হবে না বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা। প্রশমিত হলেও মানুষের শৈথিল্যের কারণে পুনরায় বাড়বে, এটিই হবে এর ধরন। ফলে ভার্চ্যুয়াল থেকে রিয়াল, বিকল্প থেকে বাস্তব স্কুল চালাতে হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কার্যকর টিকাপ্রাপ্তি পর্যন্ত। এ নিয়ে নানা আশ্বাস শোনা গেলেও এ বিষয়ে পরমুখাপেক্ষী দেশের একটি হিসেবে সবার জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা সহজ হবে না। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চের আগে কি সম্ভব?

বর্তমান অবস্থায় গত জুন থেকে সফলভাবে স্কুল পরিচালনা করছে এমন দুটি দেশ হলো ডেনমার্ক ও রাশিয়া। যত দূর জানি, দুটি দেশেই শিক্ষার্থীরা মাস্ক পরছে না, দূরত্ব রক্ষা এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সুরক্ষার উপযোগী মাস্ক দীর্ঘক্ষণ রাখলে অক্সিজেনের ঘাটতি হতে পারে, সেটি কাম্য নয়। শিশুদের মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস বেশি, তাই ঘন ঘন হাত ধোয়ার এত গুরুত্ব। তবে আসল কথা হলো স্কুল ও শ্রেণিপিছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম বলে তাদের পক্ষে দূরত্ব মানা সহজ। আবার শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকায় স্কুল চলার সময় শিক্ষার্থীদের নজরদারিও সম্ভব হচ্ছে। আমাদের বাস্তবতায় এ প্রায় অসম্ভব।

শুনেছি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সপ্তাহের ছয় দিনকে তিন দিন করে দুই পর্বে ভাগের চিন্তা চলছে। এর সঙ্গে অনলাইন যোগ হলে শিক্ষার অনেকটাই শিশুরা পাবে। কিন্তু স্কুলের সময়টুকুতে শিক্ষার্থীদের কি সর্বক্ষণ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রাখা সম্ভব হবে? সব অভিভাবক, পরিবার ও শিশুর এবং সেই সঙ্গে শিক্ষকেরও স্বাস্থ্যসচেতনতার মান এবং স্বাস্থ্য বা রোগ সংক্রমণ নিয়ে সতর্কতার ধারণা এক রকম নয়। দূরত্ব ও সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা অনেকের চর্চিত মূল্যবোধের পরিপন্থী। দেশের জনসংখ্যার বড় অংশই এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের করণীয় পালনের চেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে আগ্রহী। তার প্রতিফলন আমরা শহর-গ্রামের জনজীবনে এখন দেখছি। এ অবস্থায় যথেষ্ট সতর্কতা ও সবার সচেতনতার মান কাছাকাছি না এলে বিচিত্র পেশা, শিক্ষা, পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসা শত শত শিক্ষার্থীকে এক জায়গায় আনা ও তিন ঘণ্টা রাখা হবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বড়দের নিয়ে ঝুঁকিতে যাওয়া যায়, কিন্তু শিশুদের জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা একেবারেই চলে না। আসন্ন শীতকালে স্নান, কাপড় কাচা, হাত-মুখ ধোয়ার প্রবণতা কমে যাবে। বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন, শীতে রোগ বাড়বে।

আমার মনে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব বিষয় এখনই সর্বসমক্ষে প্রকাশ না করেও কিছু আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পারে:

১. সম্ভবত এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা বাস্তবে নেওয়া সম্ভব হবে না। তাই নবম শ্রেণি পর্যন্ত হয় শিক্ষকদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে অথবা সরকারি সিদ্ধান্তে ঢালাওভাবে পাস করাতে হবে।

২. ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে স্কুল খোলার কথা ধরে নিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি অনুযায়ী অর্থাৎ ২০২০ সালে যে যে শ্রেণিতে আছে পাঠ্যবই থেকে বাড়ির কাজ এখনই দিতে হবে, যার ভিত্তিতে তারা স্কুল খোলার পর সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা দেবে। এতে পাস করলে ভালো, অকৃতকার্য হলে দুই মাসের সময় পাবে ঘাটতি পূরণের এবং পরীক্ষা দিয়ে তা প্রমাণের। এতেও অকৃতকার্য হলে তাকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের সমাপনী পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েই পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে হবে।

৩. ২০২১ সালে নতুন পাঠ্যবই বিতরণের কর্মসূচি বন্ধ রাখা যায়। স্কুল বন্ধ থাকায় বই নিয়ে স্কুলে-কোচিংয়ে আসা-যাওয়া হয়নি, বইয়ের অবস্থা ভালো থাকার কথা। স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের গণমাধ্যম মারফত আগেই খোলার দিন সরকার-প্রদত্ত সব বই স্কুলে আনার নির্দেশনা দেবে এবং জমা নেবে। পরে শ্রেণির নতুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে তারাই বই বিতরণ করবে। ধরে নেওয়া যায় কিছু বই নষ্ট হবে, খোয়া যাবে, যার পরিমাণ ১৫-২০ শতাংশের বেশি হওয়া কথা নয়। সেটা সরকার দুই মাসের মধ্যে পূরণ করে দেবে।

৪. খোলার জন্য স্কুলের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা এখনই জানানো দরকার। যেসব স্কুলে হাত ধোয়ার বেসিন ও পানির ব্যবস্থা নতুনভাবে করতে হবে, তার জরিপ এখনই শুরু করে অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের ও হাতের জীবাণুনাশক কীভাবে দেওয়া হবে, সাবান, হাত মোছার কী ব্যবস্থা হবে এবং এসব খরচ কে দেবে, খুঁটিনাটি বিস্তর হিসাব আছে। বই মুদ্রণ থেকে সাশ্রয়কৃত অর্থ এসব খাতে ব্যয় করতে হবে।

৫. করোনা-বন্ধের সময় থেকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মূলধারার বেসরকারি স্কুলগুলো। এ রকম কোনো স্কুলই শিক্ষকদের পূর্ণ বেতন দিতে পারেনি, কিছু স্কুল আংশিক দিয়েছে, অনেক স্কুল বেতন ছাড়া চাকরি বজায় রাখছে, অনেকে বিদায়ও জানিয়েছে। এই চিত্র বাস্তবে কেমন, তা কি সরকারের জানা আছে? এটির কোনো সুরাহা না করে স্কুল খোলা হলেও কিন্তু সবার জন্য শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার শিল্প ও কৃষি খাতে প্রণোদনা দিলেও শিক্ষা খাতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রকম সহায়তা দেয়নি। ফলে শিক্ষায় বেসরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো এখন রীতিমতো ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। মনে রাখতে হবে, দেশের শিক্ষার বড় একটি অংশই বেসরকারি খাতের অধীনে চলে গেছে।

৬. শিশুদের মাস্ক সরবরাহ নিয়ে এখনই কাজ করা উচিত। তাদের জন্য মজাদার চিত্র ও শিক্ষণীয় বাণীসহ মাস্ক তৈরি করা যায়। অবশ্যই স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার দিক বিবেচনায় রেখেই এগুলো বানাতে হবে।

৭. ২০২১ সালে শিশুরা যখন স্কুলে ফিরবে, তখনো হয়তো প্রতিবেশে এবং ওদের মনজুড়ে থাকবে দুর্বিষহ সময়ের স্মৃতি ও আতঙ্ক। কীভাবে তাদের এ থেকে মুক্ত করা যাবে, একটু সানন্দে কাটানোর উৎফুল্ল সময় দেওয়া যায়, তা নিয়েও এখনই ভাবতে হবে। আমি বলব নতুন বছরে বিনা মূল্যে দুটি করে মজাদার মাস্ক আর একটি করে রংচঙে গল্পের বই দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। স্কুলে প্রথম দিনটি উদ্‌যাপিত হবে আলোর উৎসব হিসেবে। তার একটি ছক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনই তৈরি করে কাজ শুরু করতে পারে। এর বাজেটও যাবে বই মুদ্রণের সাশ্রয় থেকে।

আর একটি কথা, করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে অনলাইন প্রযুক্তি শিক্ষাব্যবস্থায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই ধাপে ধাপে শিশুদের এ ব্যাপারে সহযোগিতার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে। প্রথম পর্যায়ে বিদ্যুতের সংযোগ থাকলে সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ল্যাপটপ বা ট্যাব বিতরণ করা যায়। এমন একটি শর্তও যুক্ত হতে পারে, যেসব পরিবার সন্তানকে এসএসসি পর্যন্ত পড়াবে, তাদের বিদ্যুতের সংযোগ (না থাকলে) ও বিদ্যুৎ বিলে সরকার আংশিক সহায়তা দেবে। এ উদ্যোগ দেশে এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষিতের হার বাড়াতে সহায়ক হবে।

পুরো জাতিকেই বলব, শিশুদের কথা একটু ভাবুন, এক বছর বাধ্যতামূলক গৃহবন্দী থাকার অভিজ্ঞতা ওদের মনের ওপর কী রকম চাপ তৈরি করতে পারে, তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার বিষয়। ওদের জন্য আরও অনেক কিছুই করার আছে আমাদের। অনেক কথা বলা হলেও ওদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়েও আছি। এটা রীতিমতো অন্যায়, একটু কঠোর শোনালেও বলব, অপরাধ। আমরা শিশুদের কাছে অপরাধী।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক