আমরা কেন নির্মাণকাজ এত ভালোবাসি

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাদগাঁওয়ে চেলার খালের ওপর নির্মিত সেতু

ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ, বিদ্রোহ–বিপ্লব ইত্যাদি মানুষিক তাণ্ডব এসে ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, হাটবাজার, মসজিদ–মন্দির ইত্যাদি ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে গেলে মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়, কিন্তু পর্যুদস্ত হয় না। বরং অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ তাকে নতুন করে নির্মাণের স্বপ্ন দেখায়। তাই ‘নির্মাণ’ ইতিবাচক, খুবই উদ্দীপনাময় একটি শব্দ।

রাষ্ট্র নির্মাণ, সমাজ নির্মাণ, জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ—এ রকম আরও অনেক শব্দবন্ধ আছে; সেগুলোর সবই ইতিবাচক ও উদ্দীপনাময়। ‘নির্মাণ’ কথাটা শুনলেই যেন জোশ চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পরপর এই জোশটা সম্ভবত তুঙ্গস্পর্শী ছিল। অন্তত সে রকমই কথা ছিল: স্বাধীন–সার্বভৌম বাংলাদেশে আমরা একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ‘নির্মাণ’ করব।

অবশ্য এই কালে ‘নির্মাণ’ শব্দটা উচ্চারিত হলে রাষ্ট্র নির্মাণ, সমাজ নির্মাণ—এই সব মহৎ ব্যাপার আর মনে আসে না। সেতু নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, ভবন নির্মাণ—এই রকম অজস্র অবকাঠামো নির্মাণের ভিড়ে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন চাপা পড়ে গেছে। অবশ্য নানা ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণও দরকারি কাজ। এই সব ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ চলে না। কিন্তু আমরা শুধু যে সেই কারণে নানা ধরনের ‘নির্মাণ’ ভালোবাসি, তা নয়। কোথায় কী নির্মাণ করলে দেশ–জাতির কত উপকার হবে, এটা চিন্তা করার মানুষ খুব একটা আছে বলে ভরসা হয় না, যা নির্মাণ করার জন্য জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়, তার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না, তা–ও ভেবে দেখার মানুষ বিরল (যাঁরা এসব ব্যাপারে প্রস্তাব তোলেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে)।

এই কালে ‘নির্মাণ’ শব্দটা উচ্চারিত হলে রাষ্ট্র নির্মাণ, সমাজ নির্মাণ—এই সব মহৎ ব্যাপার আর মনে আসে না। সেতু নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, ভবন নির্মাণ—এই রকম অজস্র অবকাঠামো নির্মাণের ভিড়ে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন চাপা পড়ে গেছে।

২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় চার কলামজুড়ে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাদগাঁওয়ে চেলার খাল নামের এক অপরিসর খালের ওপরে নির্মিত হয়েছে ঝকঝকে নতুন একটি সেতু। সেতুটি পার হলেই সড়ক ফুরিয়ে গেছে: সামনে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠ। কেন, কার কী প্রয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছে এই সেতু? এ রকম অর্থহীন, গন্তব্যহীন, অপ্রয়োজনীয় সেতু কি বাংলাদেশজুড়ে এই একটাই নির্মিত হয়েছে?

জি না। সারা দেশে এ রকম সেতুর সংখ্যা হাজার হাজার এবং এগুলোর নির্মাণ চলে আসছে বহু বছর ধরে। ২০০৮ সালে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা সারা দেশে এই সব সেতুর খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার ভিত্তিতে চার পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছিল বিশেষ ক্রোড়পত্র। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) কাছে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, দেশের ৬২টি জেলায় নির্মাণ করা হয়েছে ২ হাজার ৭২৮টি সেতু, যেগুলোর কোনো ব্যবহার নেই। অর্থাৎ ওই সব সেতু পার হয়ে কোথাও যাওয়ার নেই।

সেতু নির্মাণ করা হয় সড়কে, সড়ক দিয়ে সেতুতে উঠতে হয়, সেতু থেকে নেমে সেই সড়ক দিয়েই গন্তব্যের দিকে যেতে হয়। কিন্তু ওই প্রায় পৌনে তিন হাজার সেতুর কোনো পাশে কোনো সড়ক ছিল না। সড়ক নেই, খাল–নদী নেই, স্রেফ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পাকা সেতু—এমন দৃশ্যে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর জনগণের করের টাকা ব্যয় করে সারা দেশে এ রকম শত শত সেতু–কালভার্ট নির্মাণ করা হয় কী উদ্দেশ্যে?

শুধু সেতু–কালভার্ট নয়, আরও অজস্র রকমের স্থাপনা–অবকাঠামো নির্মাণের আসক্তি পেয়ে বসেছে আমাদের। ইউএনডিপির বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে মাথাপিছু হাসপাতাল শয্যার সংখ্যা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ওই দুটি দেশেই প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালের শয্যা আছে ৬টি করে, আর আমাদের দেশে আছে ১০টি।

কিন্তু মানুষের অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যার দিক থেকে আমরা ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। পাকিস্তানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন ৯ দশমিক ৮ জন, ভারতে ৮ দশমিক ৬ জন, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন মাত্র ৫ দশমিক ৮ জন। হাসপাতালের সংখ্যা বেশি, সেই তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম—এই অবস্থার মাজেজা কী? এর মাজেজা হলো, হাসপাতালের ভবন নির্মাণের প্রতি আমাদের যত আগ্রহ, চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার বেলায় ততটা নেই। কারণ, নির্মাণকাজে টাকাপয়সার নয়ছয় করা যায়, নিজের সম্পদ বাড়ানো যায়, চিকিৎসক নিয়োগের বেলায় সে সুযোগ নেই।

ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ভেঙে আধুনিক ইমারত নির্মাণের প্রবণতার পেছনেও একই অনৈতিক কারণ কাজ করে বলে প্রতীয়মান হয়। নির্মাণকাজের প্রতি আগ্রহ সাংসদ, জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অতিক্রম করে শিক্ষাঙ্গনেও বিস্তৃত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ নীতিনির্ধারকদের কাছে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে নানা রকমের ভবন নির্মাণের বিপুল অর্থকরী কর্মযজ্ঞ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এ–সংক্রান্ত অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

জনগণের টাকায় যেকোনো কিছু নির্মাণের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আসক্তির প্রধান কারণ অনৈতিক: সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় ‘পাবলিকের ট্যাকা মাইরা’ নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ।

এবার শোনা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা–কমপ্লেক্সটি ভেঙে সেখানে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। এর পেছনে জনগণের কত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হবে, এখন পর্যন্ত আমরা তা জানি না। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি ভেঙে ফেলতে হবে কেন?

জনগণের টাকায় যেকোনো কিছু নির্মাণের প্রতি আমাদের অতিরিক্ত আসক্তির প্রধান কারণ অনৈতিক: সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় ‘পাবলিকের ট্যাকা মাইরা’ নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ। একবার এক ফুটপাতের নির্মাণশ্রমিক এই লেখককে বলেছিলেন,
‘ভালা ফুটপাত ভাইঙ্গা নতুন কইরা বানাইতাছে ট্যাকা মারনের লেইগা। দুই বছর পর দেইখেন, আবার ভাইঙ্গা আবার বানাইব।’

আমাদের নির্মাণ–আসক্তি একটা রোগে পরিণত হয়েছে; নৈতিকতা ধ্বংসকারী এই মারাত্মক রোগ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী সব স্থাপনার জন্যই বিরাট হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক

[email protected]