আমরা কেবল দুর্নীতিবাজ নই, আমরা অদক্ষও

দ্য প্রিন্ট (দ্যপ্রিন্ট.ইন) পত্রিকার ১ জুন ২০২১ সংখ্যায় মিহির শর্মা লিখেছেন: কেন ভারত কিংবা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির তারকা? তিনি বলছেন, পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৪৩ ডলার আর বাংলাদেশের ২ হাজার ২২৭ ডলার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ধনী, এখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। মিহির শর্মার মতে, বাংলাদেশের উন্নতি দাঁড়িয়ে আছে তিনটা খুঁটির ওপরে—রপ্তানি, সামাজিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাবধানতা। ভারত বা পাকিস্তান যা পারেনি, তা পেরেছে বাংলাদেশ—শ্রমশক্তিতে নারীর অংশ তারা ধারাবাহিকভাবে বাড়িয়েই চলেছে।

অর্থনীতিতে বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্যারাডক্স বা বিরোধাভাসের কথা আসে। জবাবদিহির অভাব, দুর্বল গণতন্ত্র, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রাণচঞ্চল?

প্রায় একই বিরোধাভাস দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। আপনি বাংলায় স্বাস্থ্য খাত নিয়ে গুগল করুন, দেখবেন গত ছয় থেকে সাত বছরের খবরগুলোর প্রায় সবই নেতিবাচক—দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম। ২০১৪ সালে ৯ নভেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল: ‌‘সম্প্রতি “স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়” শীর্ষক টিআইবির প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয় বলে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা এই খাতের দুর্নীতির ভয়াবহতাকেই তুলে ধরছে। টিআইবির গবেষণা টিম এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে ভুক্তভোগী চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগনির্ণয় কেন্দ্র ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসাসেবার মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা কেন এই অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবেন?’

হাসপাতালগুলোতে কেনাকাটায় দুর্নীতির খবরে সংবাদমাধ্যমগুলো সয়লাব। এর মধ্য থেকে ডয়চে ভেলের ১৯ জুন ২০২০-এর একটা খবর থেকে উদ্ধৃতি দিই:

‘গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির যে ১১টি খাত চিহ্নিত করে, তার মধ্যে বেশি দুর্নীতি হয় কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ খাতে। সাদাচোখে দেখা দুর্নীতির বাইরে একটি অভিনব দুর্নীতির কথাও তখন বলে দুদক। আর তা হলো দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা। এমন যন্ত্রপাতি কেনা হয় যা পরিচালনার লোক নেই। ওই সব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না...

‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতি কেনায়—২৭টি সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটার তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির এই চিত্র প্রকাশ করে:

‘...ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এক সেট পর্দার দাম দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। ১৭৫ কোটি টাকার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য। রংপুর মেডিকেল কলেজে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও চার কোটি টাকার সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা কখনোই ব্যবহার করা হয়নি।’

প্রথম আলোয় প্রকাশিত রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোর কথা না হয় না-ই বললাম।

আমাদের স্বাস্থ্য খাত যে করোনার চেয়েও ভয়াবহ অতিমারিতে জর্জরিত, এই খবরগুলো তার সামান্য কিছু নজির মাত্র। এরই মধ্যে প্রথম আলোই প্রকাশ করে চলেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশের অগ্রগতির খবর, ধারাবাহিকভাবে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্জনগুলোর কথা লিখে চলেছে প্রথম আলো—৫০ বছরে গড় আয়ু ২৬ বছর বেড়ে হয়েছে ৭২ বছর ৭ মাস, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৮৫ শতাংশ, মাতৃমৃত্যু লাখে ৬০০ থেকে কমে এসেছে ১৬৫-তে, টিকাদানে বাংলাদেশের সাফল্য পৃথিবীতেই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার মতো, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে আমাদের খাবার স্যালাইন, প্রজননহার কমেছে, গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রত্যন্ত এলাকায় দিচ্ছে চিকিৎসাসুবিধা, জনস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা গবেষণার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে মতলব। স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থার নৈরাজ্যের খবর যেমন পেয়েছি প্রথম আলোতে, তেমনি স্বাস্থ্য খাতে এই উন্নতির খবরও পড়ছি প্রথম আলোতেই। আবারও সেই ধাঁধা, প্যারাডক্স।

এখন ভাবুন, যদি আমাদের দেশে দুর্নীতি না থাকত, অব্যবস্থাপনা না থাকত, অদক্ষতা না থাকত, তাহলে স্বাধীনতার ৫০ বছরেই আমরা কোথায় যেতাম?

দুর্নীতির একটা কারণ জবাবদিহি না থাকা, নজরদারি না থাকা, পাহারা না দেওয়া, দুর্নীতিবাজদের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিচার ও সাজা নিশ্চিত না করা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আলো আছে, অন্ধকারও আছে, যদি সুযোগ পায়, মানুষ অন্ধকারের দিকে যায়। যদি পাহারা থাকে, শাস্তির ভয় থাকে, তাহলে মানুষ ভালো হয়ে চলে। আজকে করোনার কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের ওপরে আলো পড়েছে বলে থলের বিড়ালের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে, অন্য খাতগুলোতে নজর দিলে অবস্থার এদিক-ওদিক হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু এর পাশাপাশি দুর্নীতির একটা বড় কারণ বলে মনে হচ্ছে অদক্ষতাকে। আমরা বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৪২ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। আর এ ক্ষেত্রে যেসব মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার একটি। আমরা টাকা খরচ করতে পারি না। সেটা আবার বছর শেষে আমাদের দুর্নামের কারণ হয়। তাই তড়িঘড়ি করে আমরা টাকা খরচ করতে থাকি। দুই কোটি টাকা বরাদ্দ আছে, দরকার দুইটা চকি কেনা, তাহলে কিনে ফেলো, দুইটা চকি ৪০ লাখ, চারটা গদি ৪০ লাখ, পাঁচটা চাদর ৫০ লাখ—স্যার, তবু তো দুই কোটির হিসাব মেলে না, কী করব? আরে মিয়া, মশারি কেনেন, মশারি টাঙানোর জন্য দড়ি কেনেন, খাট জোড়া দেওয়ার জন্য মিস্ত্রি লাগান, মাত্র দুই কোটি টাকার বাজেট বানাতে পারেন না, করেনটা কী?

এর মানে হলো, আমাদের আসলে দক্ষতা বাড়াতে হবে। বালিশ তুলতে খরচ দেখানো, পর্দা কিনতে লাখ টাকার বাজেট, কোটি টাকার যন্ত্র কিনে হাসপাতালে কিংবা বিমানবন্দরে ফেলে রাখার পেছনে যেমন আছে দুর্নীতি, লোভ, তেমনি আছে অদক্ষতা। কাজেই আপনারা যখন বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ান, তখন আমি বলি, সব ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ান। কার দক্ষতা? মানুষের। দক্ষ মানুষ তৈরি করুন। আমাদের মানুষেরা কেবল শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাবে না, তারা যাবে ব্যবস্থাপক হিসেবে, দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ম্যানেজার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আমাদের দেশে আজকে গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোয় ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন ভারতীয় আর শ্রীলঙ্কানরা। আর আমরা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহপরিচারিকার অভাব মেটাচ্ছি।

আসলে দরকার দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে গুরুতর গলদ আছে, এই দুর্নীতি-অব্যবস্থা-অদক্ষতার খবরগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আমাদের ব্যবস্থাপক তৈরি করতে হবে। আমাদের দক্ষ প্রশাসক তৈরি করতে হবে। আর দরকার মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। আমরা খুবই লজ্জা পাই, যখন দেখি, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে, প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করার অভিযোগে বিক্ষোভ হয়। আমাদের শিক্ষিতজনদের মূল্যবোধের এত অবনতি ঘটল কী করে? দলীয়করণের কারণে, অযোগ্যকে বড় পদে বসানোর ফলে?

বাংলাদেশ উন্নতি করছে। স্বাস্থ্য খাতেও আমাদের উন্নতি প্রশংসনীয়। কিন্তু দক্ষ, সুনীতিমান, মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরির কাজটাতে মনোযোগ দিতে হবে। আর দরকার একটা বিশেষ আন্দোলন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ৩৬০ ডিগ্রি আন্দোলন। নইলে মাথাপিছু আয় বাড়বে, কিন্তু তা যাবে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পকেটে এবং সে টাকা পাচার হবে বিদেশে; দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, যারা এই রাষ্ট্রের মালিক, তারা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে যাবে। সেটা মোটেও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নয়।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক