আমরা কেমন নির্বাচন চাই

নির্বাচন এখন পঞ্চাশ ঘণ্টারও কম দূরত্বে। বছরের শুরুতে একটা শঙ্কা ছিল, নির্বাচন আদৌ হবে কি না। সেই শঙ্কা কেটেছে। নির্বাচন হচ্ছে এবং আগামী ঘণ্টাগুলো নির্বিঘ্নে পার করতে পারলে অন্তত বলতে পারব, অনেক দলের অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচন স্বচ্ছ হলো কি না, শান্তিপূর্ণ হলো কি না, এটি নির্বাচনের দিন পার করলেই শুধু বলা যাবে। একইভাবে নির্বাচনের পর কোনো সন্ত্রাস হবে কি না, সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হবে কি না, তা–ও বলা যাবে আরও কিছুদিন পরই। তবে নির্বাচন যে খুব শান্তিপূর্ণ হচ্ছে না, তা তো প্রতিদিনের সংঘর্ষ, হামলা-মামলা থেকে দেখা যাচ্ছে।
হামলায় দুই দলের অনুসারীরাই আক্রান্ত হয়েছেন, যদিও বিএনপিই যে আঘাতটা বেশি সামলাচ্ছে তা–ও তো দৃশ্যমান। বিএনপির কয়েকজন প্রার্থী আহত হয়েছেন, মাহবুব উদ্দিন খোকন ও গয়েশ্বর রায়ের ছবি বেরিয়েছে পত্রিকায়—একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অন্যজনের গায়ে আঘাতের রক্ত। এসব সংঘাত যে গণতন্ত্রের পক্ষে যায় না, সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে যায় না, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ২৪ তারিখ থেকে সামরিক বাহিনী পাঠানো হয়েছে উপজেলাগুলোতে। কিন্তু তারপরও হামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপিসহ অন্যান্য দলের অনেক কর্মী–সমর্থক। যদিও গ্রেপ্তার করার সমর্থনে অনেক কথা বলা হচ্ছে, তাতে মানুষের মনে আস্থা আসছে না। সাতক্ষীরা ও দিনাজপুরের অনেক গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের স্ত্রী–কন্যাদের অন্য এলাকায় আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভোট থেকে জীবন ও সম্ভ্রম বড়, তঁারা ভেবেছেন। তঁাদের ২০০১ ও ২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা আশঙ্কাটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বড় দলগুলো নির্বাচন নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল, যদিও তাদের ভেতর চিন্তাভাবনায় অনেক ফারাক ছিল। জনগণ সেই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে এবং ভোট উৎসবের কল্পনা করতে শুরু করেছে। তাহলে কেন নির্বাচন কীভাবে হবে, সহিংসতা পরিহার করে সত্যিকার উৎসবের আমেজে নির্বাচন করার জন্য তাদের আলোচনা হলো না? যদি আলোচনা হতো এবং একটা আচরণবিধি তারাই তৈরি করে ফেলত, তাহলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। যেখানে নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি তৈরি হয় ভাঙার জন্য, ভেঙেই প্রার্থীরা সুখ পান; তাহলে বড় দুই দলের করা আচরণবিধি হয়তো চর্চাটা পাল্টে দিত।
যা হয়নি, তা নিয়ে আক্ষেপ করাটা অবশ্য কাজের কথা নয়। এখন যদি আমাদের ভাবতে হয়, কেমন নির্বাচন চাই। তাহলে আগামী কয়েক ঘণ্টার হিসাবটাতে ফেলেই আমাদের কথাবার্তা বলতে হবে। তারপরও এত দিন কেন নির্বাচনী প্রচারণাটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ হলো না, এই আক্ষেপটা আমাদের থেকেই যাবে।
এক কথায় যদি বলতে হয়, তাহলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হোক, স্বচ্ছ হোক এবং নির্বিঘ্ন হোক ও কথাটিই আমাদের প্রথম মনে আসবে এবং তা সম্ভব হবে যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা তঁাদের দায়িত্ব সর্বাত্মক নিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষতা দিয়ে পালন করেন। এটি জনগণ তঁাদের থেকে আশা করে, যেহেতু তঁারা রাষ্ট্রের কর্মচারী, কোনো দলের সঙ্গে তঁাদের সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা নয়। দুঃখজনকভাবে, আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসন ও পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, বিরোধী অবস্থানে গেলে এর সমালোচনা করে। নির্বাচনের দিন যেহেতু সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে, আমরা আশা করব, পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হবে। মানুষ যদি নিজেদের ভোটটা নিজেরাই দিতে পারে, নির্বাচনের ফল যা–ই হোক, জয়ী হয় গণতন্ত্র।
এ নির্বাচন ঘিরে মানুষের একটা আশা ছিল, আমরা হয়তো এর মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উত্তরণ ঘটাতে পারব, সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পাব। ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল, যে ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতে ইসলামীবিহীন জোটের উদ্যোগ নিয়েছিল, তাঁরাই জামায়াতের প্রার্থীদের সঙ্গে ধানের শীষে লড়াই করেছেন, তখন আমাদের হোঁচট খেতে হয়েছে। এককালের নৌকার কান্ডারি, একাত্তরের সাহসী সৈনিক এখন ধানের শীষের প্রার্থী। এককালের ধানের শীষের একনিষ্ঠ অনুসারীরা এখন নৌকার মাঝি। এই দলবদল কোনো আদর্শকে প্রতিফলিত করে না। আমরা যে আদর্শবোধ ও মূল্যবোধের রাজনীতি ও নির্বাচন চাই, তা আর হচ্ছে না, তারপরও আমরা আশা করব। নিজের ও দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জয়ীরা এবং পরাজিতরা যেন মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, তঁাদের মঙ্গলের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
আমরা চাই নির্বাচন নিয়ে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও প্রতিহিংসা যেন না দেখতে হয়। নির্বাচনের পরে যে সরকার গঠিত হবে, তা যেন বিরোধীদের আস্থায় নিয়ে, তাদের শত্রু বিবেচনা না করে দেশ চালায়। বিএনপির ইশতেহারে আছে, তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না। তা যেন শুধু কথার কথা হয়ে না থেকে যায়। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে তারাও যেন নতুন একটা সূচনা করে। রাজনৈতিক কারণে দেওয়া সব মামলা তুলে নিয়ে দেশে একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করে।
নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে, অর্থ ব্যয় ছাড়া নির্বাচনের মাঠ পার হওয়া যায় না। কিন্তু এই টাকার খেলা দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় দুটি দলের ইশতেহারেই অনেক সুন্দর সুন্দর প্রতীক্ষা আছে। এগুলো প্রতিপালনের জন্য আমরা আহ্বান জানাই।

২.
নির্বাচন কেমন চাই—প্রশ্নটি নিয়ে বেশি লেখার কিছু নেই। কারণ আমরা যা চাই, বাস্তবতা তার থেকে অনেক দূরে থেকে যায়। কিন্তু যে জাতির একটা বিশাল গৌরবের ইতিহাস আছে, সে জাতি কেন একটা ভালো নির্বাচন পাবে না, বা রাজনীতিবিদদের বাধ্য করতে পারবে না ভালো নির্বাচন দিতে? আমি বিশ্বাস করি, সেই দিকে কিছুটা হলেও আমরা এগোচ্ছি। তরুণেরা কথা বলছে, তাদের কথা রাজনীতিবিদেরা শুনছেন না, কিন্তু আমরা যাঁরা শিক্ষক, তরুণদের সঙ্গেই দিনভর ওঠাবসা, তাঁরা শুনছেন। আমি দেখেছি, তারা অনিয়মকে, অন্যায়কে ঘৃণা করে; তারা রাষ্ট্রের মেরামত চায়। আজ চাইছে, কালই হয়তো পারে না, কিন্তু পরশু, না হয় পরের সপ্তাহে পারবে। বাংলাদেশ তারুণ্যনির্ভর, অসম্ভব সম্ভবের একটি দেশ।
তরুণেরা যদি দলে দলে ভোটকেন্দ্রে যায়, ভোট দেয়, নিজের এবং অন্যের ভোটের দাবি অর্জনে সফল হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনে আমরা হয়তো বলতে পারব অতীতকে আমরা সত্যিই পেছনে ফেলে আসতে পেরেছি। আগামী ভোটের আগে আমরা বাংলাদেশের ৫০তম, বঙ্গবন্ধুর ১০০তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম জন্ম ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে ফেলব। দেশটা আর ২০১৮–এর বাস্তবতায় থাকতে অস্বীকার করবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ