আমলাদের নিয়ে রাজনীতিবিদদের দুঃখ ও পালাগানের আসর

আওয়ামী লীগের দিক থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলেন। এরশাদের এক দশকেও রাজনীতি করা কঠিনই হয়ে গিয়েছিল। দেশ চালাতেন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ থেকে শুরু করে জাতীয় পার্টির নেতা ফিরোজ রশীদ অভিযোগ করছেন খোদ সরকারের প্রতি যে দেশ রাজনীতিশূন্য হতে চলেছে। রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতাহীন হয়ে গেছেন। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা।

তোফায়েল আহমেদ সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনার সময়ে বলেছেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে। …এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেয়। অথচ প্রশাসনিক যারা কর্মকর্তা, তারা কিন্তু যায়ইনি। যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক না। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’
ওইই একই দিনে সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ‘এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে…দেশে কোনো রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ কোনো রাজনীতি নেই তো। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। …এই পালাগান চলছে ১০ বছর। রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’

কাজী ফিরোজ আরও বলেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এই দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদেরা।’

আর সব দিক বাদ দেওয়া যাক। করোনা মহামারির চেয়ে বড় ‍দুর্যোগ আর কী হতে পারে? সব মহল থেকে অভিযোগ এসেছে, আহ্বান এসেছে, হাহাকার জেগেছে যে রাজনীতিবিদেরা এই ‍দুর্যোগে কোথায়? প্রতিটি জেলার দুর্যোগ মোকাবিলার দায়িত্বে রয়েছেন একেকজন সচিব। তোফায়েল আহমেদ অভিযোগ করেছেন, তাঁরা এলাকায় যান না। গেলেও একবার মাত্র। তাহলে রইল কে? রইলেন কেবল ডিসি। তা–ই যদি হয়, তাহলে এত জ্বালা সয়ে এমপিদের নির্বাচিত করা কেন? নির্বাচন নামক রক্তক্ষয়ী তামাশাই–বা কেন। সরকার যদি নিজেই নিজেদের জনপ্রতিনিধিদের আস্থা না করে, তাহলে মানুষ কী করবে? মানুষ তখন দিগ্‌বিদিক ছুটবে। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে রেকর্ড গড়েছে। কথাটায় সত্যতা রয়েছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের কম না। এসব অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২। এটি একটি চমৎকার আইন। অথচ আইন আছে আইনের জায়গায়, মহামারি মোকাবিলা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এই আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে বলা আছে, ‘(১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তিবর্গকে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদানের নিমিত্ত জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল নামে একটি কাউন্সিল থাকিবে।’

এই কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রীসহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়, সব বাহিনীর প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ অনেকেই থাকবেন। তাঁদের কাজ হবে, ‘(ক) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নীতিমালা ও পরিকল্পনা–সংক্রান্ত কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান’ এবং তার বাস্তবায়নে সম্ভব যা কিছু তা করা। আর এটা হবে ‘বহু সংগঠনভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’। এর অধীনে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা-পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ এবং ‘দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ’ গঠনের কথা বলা আছে।

এ ধরনের কমিটি ইতিমধ্যে গঠিত থাকবারও কথা। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সমন্বিতভাবে কাজের পদ্ধতি তৈরি করা আছে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। এই আইন অনুযায়ী কাজ করা গেলে করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগে আমরা আরও কার্যকরভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারতাম। ফলে দেখা যাচ্ছে সমন্বয়হীনতা।

কাকে বলে ‘লকডাউন’, কাকে বলে ‘সীমিত পরিসর’ আর কাকে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’—সব ভুলতে বসেছি আমরা। জনাব তোফায়েল আহমেদের এই আক্ষেপের সুযোগই থাকত না, যদি ওই ‘বহু সংগঠনভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’ অবলম্বন করা হতো। কিন্তু তা হয়নি। রাজনীতিবিদেরা এই প্রক্রিয়ার বাইরে দর্শক হয়ে আছেন। যদি সরকারদলীয় সাংসদদেরই এই অবস্থা হয়, তাহলে বিরোধী দলের কী অবস্থা?
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তা করতে পেরেছে। সাফল্যের সঙ্গে তারা রাজনীতি থেকে বিএনপিকে মাইনাস করেছে। এখন খোদ আওয়ামী লীগ সরকারই যদি আপন দলের রাজনীতিবিদদের বসিয়ে রাখে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা তো থাকছেই; আওয়ামী লীগ নামের এই প্রাচীন দলের কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

সংসদীয় গণতন্ত্র মানে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ক্ষমতাকে সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে বণ্টন। সেই ক্ষমতা যদি সচিব ও ডিসিদের হাতে চলে যায়, তাহলে নামকাওয়াস্তেও এটা বলা কঠিন যে দেশে সংসদ আছে বা গণতন্ত্র আছে। তখন সংসদ পরিণত হয় কাজী ফিরোজ রশীদকথিত পালাগানের আসরে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।

[email protected]