রাজনীতিবিদেরা কেন ক্ষমতাহারা?

রাজনীতিবিদেরা সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়নের মডেল তৃণমূল পর্যন্ত ‘প্রশাসক’ নিয়োগকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতাচর্চার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারও কারও মতে, আমলারা খেলছেন, গোল দিচ্ছেন আর রাজনীতিবিদেরা দর্শক হয়ে খেলা দেখছেন, কিন্তু খেলাটা তাঁরা উপভোগ করতে পারছেন না। কেউবা সাংসদদের শুধু ‘হ্যাঁ বা না’ বলার সদস্য হিসেবে দেখছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের উপলব্ধিটা এত দেরিতে এসেছে কেন?

রাজনীতিবিদেরা ভোটহীন টানা দুটি জাতীয় নির্বাচন করে ফেললেন, সংসদ উপনির্বাচন, উপজেলা, ইউনিয়নসহ সব স্থানীয় নির্বাচন করছেন একতরফাভাবে। দলবাজি ও দুর্বৃত্তায়নের কাঠামোকে দলীয় প্রতীকসহ একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাজনীতিবিদদের কোনো আপত্তি নেই। দলীয় কোন্দলের মারপ্যাঁচে কোনোমতে শুধু মনোনয়ন বাগিয়েই মন্ত্রী-সাংসদ-মেয়র-চেয়ারম্যান হওয়াই ‘বিজয়ের’ বিষয়। রাজনীতিবিদদের জয়ে ভোটের নির্ভরতা নেই। ইলেকশন বন্ধ করার প্রক্রিয়ায় সিলেকশন পেয়েই রাজনীতিবিদ দিগ্বিজয়ের হাসি হেসেছেন।

স্থানীয় সরকার, সচিবালয় থেকে বিচারালয়ের সর্বত্রই ‘আমাদের লোক’ বসানোর ষোলোকলা পূর্ণ করার পর পুলিশ দিয়ে প্রতিবাদ দমনের নিশ্চয়তা এসেছে। মামলা, জেল জুলুম ও গুমের ঘটনা যেভাবে ঘটছে তাতে রাজনীতির মাঠ একেবারে ঠান্ডা করা গেছে। বিরোধীদের ওপর আড়িপাতার বিদেশি যন্ত্রপাতি, ট্র্যাকিংয়ের উন্নত প্রযুক্তি হস্তগত হয়েছে। আন্দোলন চেষ্টার সঙ্গে ব্যাংকের হিসাব নজরদারি এবং জামিন নামঞ্জুর—উভয়কেই সংযুক্ত করা গেছে। তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচিত হওয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাগরিক সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর সংবাদমাধ্যমকে ভীতসন্ত্রস্ত ও সেলফ সেন্সরশিপে আটকানো গেছে।

এসব ক্ষমতায়নের মূল উৎসে যে আমলারা ছিলেন, রাজনীতিবিদেরা গোল্ডফিশের মতোই তা বেমালুম ভুলে গেছেন। যে আমলাদের মাধ্যমে রাতের ভোট বা বিনা ভোটের আয়োজন হয়েছে, সেই আমলারা রাজনীতিবিদদের অধীন করবেন, এটাই তো প্রত্যাশিত ছিল!

যেখানে মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ওপর একক ক্ষমতাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়েছে সেখানে শাসনতন্ত্রে কে কার ওপর থাকবে, এই আলোচনা অর্থহীন। কারণ রাজনীতিবিদেরা সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের আলাদা করার প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতার ভারসাম্য ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সমুদয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। সংবিধানের ৫৫, ৫৮ ও ৭০ অনুচ্ছেদের মতো ধারা কার্যকর রেখে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা আসলে কতটুকু সম্ভব?

বিএনপিসহ বিরোধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দমন করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তারের বহু পরে এসে এককালের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ দেখছেন, আহা! রাজনীতি বিষয়টাই তো হারিয়ে গেছে!

৫৫ (২) অনুচ্ছেদ: প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে। ৫৬ (১) অনুচ্ছেদ: ‘প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রী থাকিবেন।’ ৫৮ (২) অনুচ্ছেদ: ‘প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময়ে কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন।’ ৭০ অনুচ্ছেদ: ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি— (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

দ্বিকক্ষের সংসদ, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচনসহ ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সব চেষ্টায় বাধা দিয়ে রাজনীতিবিদেরা স্থানীয় সরকারকে অকার্যকর করে রেখেছেন। ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে এমন ‘অর্থহীন’ সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে দুটা কথা বলতে পারলেও ভোট ও ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না সাংসদেরা, ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অনুকূলে ‘হ্যাঁ-না’ কণ্ঠভোটে অংশ নেওয়া ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে সচিবের ওপরে সাংসদদের থাকার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই অর্থহীন।

বাস্তবতাটা হচ্ছে, অনির্বাচিত ‘রাজনীতিবিদদের’ অনেকের সরকারি বরাদ্দ চুরি, সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে তাঁরা সরকারের দৈনন্দিন কাজে বড়সড় বাধা হয়ে উঠেছেন। উপরন্তু জবাবদিহিহীন সংস্কৃতিতে সততা, যোগ্যতা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা মাপার প্রক্রিয়া বন্ধ। এখন সম্ভবত যোগ্যতার মাপকাঠি হচ্ছে চাঁদা তোলা, সন্ত্রাস করার সামর্থ্য আর বিরোধী মতের মানুষকে পেটানোর সক্ষমতা। এখন যারা রাজনীতিতে আসছেন তাঁদের একটি বড় অংশ হয় কালোটাকার মালিক নয়তো বড়জোর ব্যবসায়ী। তাঁদের যোগ্যতা ব্যবসায় লাভ করা, প্রকল্পের অর্থ হাতানো কিংবা অর্থ মেরে দেওয়ায়। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়ে নেতা হননি বলে উন্নয়ন সহযোগী, বিদেশি পক্ষ, করপোরেট শ্রেণির সঙ্গে কাজ করা কিংবা আধুনিক প্রশাসন পরিচালনায় তাঁরা অদক্ষ ও অযোগ্য।

এই অযোগ্যদের বিপরীতে ‘বিসিএস’ উত্তীর্ণ আমলাদের পদায়নে ও ক্ষমতায়নে গতি এসেছে। প্রশাসনিক কাজকর্মে স্বাভাবিকতা ফেরাতে এটা ছিল অবধারিত নিয়তি। এটা জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের আমলাতান্ত্রিক মডেল, নতুন কিছু নয় বরং রাজনীতিহীনতার কালে বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতা কাটানোর অক্ষম চেষ্টামাত্র!

বিএনপি-জামায়াতের বাইরে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বিকল্প তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ভোটাধিকার হরণের নৈরাজ্যকে নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দিতে পুলিশ প্রশাসন সাজানোর কাজটা আগেই শেষ হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দমন করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তারের বহু পরে এসে এককালের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ দেখছেন, আহা! রাজনীতি বিষয়টাই তো হারিয়ে গেছে! অথচ বিকল্প কে হবে, সেটা ঠিক করে দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার ছিল জনতার, যে ভোটের মাধ্যমে বলে দেবে কে হবেন তার ভবিষ্যৎ নেতা।

রাজনীতিবিদ’ হয়ে সংসদে, সিটি ও পৌর করপোরেশনে আসার ইচ্ছা পোষণ করা লোকের কথা ছিল জনতার দুয়ারে ভোট চাইতে যাওয়ার, কিন্তু এখন সেখানে যেতে হয় না। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় তদবির করলেই মনোনয়ন আর সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই বিজয়।

‘রাজনীতিবিদের’ মুখে কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের তত্ত্ব শোনা গেল। অথচ ছোট-বড় যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদের অযোগ্যতা ভয়াবহতার মাত্রা ছাড়িয়েছে, ব্যয় শুধু বাড়ছেই, প্রকল্পগুলো উদ্বোধনে আসছে না। এক যুগ ধরে উন্নয়নের নন্দনতত্ত্ব প্রচারের পরের দৃশ্যে নাগরিক দেখছে, নতুন নির্মিত ব্রিজ, রাস্তাগুলো ভেঙে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে বছর পরেই; ব্যাংকগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছেই, সামান্য বৃষ্টির পানি নগরের রাস্তাঘাট সয়লাব হয়ে ঘরে ঢুকছে।

এক যুগের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন গপ্পের পরে করোনার আঘাতে ৪২ শতাংশ জনতা গরিব হয়েছে। নিরেট মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মুখ আড়াল করেন টিসিবির ট্রাকের সারিতে। বর্ষায় ড্রেনের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে নগরী। ফ্লাইওভারের ওপরের জলাবদ্ধতার জ্যামে বসে বসে জনতা নিচের পানিতে নৌকা চলার দৃশ্য দেখছে। তেল ও তোষামোদির লাঠিয়াল রাজনীতি দিয়ে তথাকথিত জনপ্রতিনিধি হয়ে, জনস্বার্থ বেকারত্ব-দারিদ্র্য নিয়ে কিছু বলতে পারেন না ‘রাজনীতিবিদ’, পারেন না খাদ্য ও অর্থ সাহায্যহীন অপরিকল্পিত লকডাউনের প্রতিবাদ করতে। অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই বাজেটের দাবি, মহামারি নিয়ন্ত্রণে ‘সমন্বিত জাতীয় টাস্ক ফোর্স’ দাবি করতে ‘রাজনীতিবিদের’ ভয়। বাজেটের গুণগত মান পরিবর্তনে সাংসদদের ভূমিকা নেই বললেই চলে।

‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে সংসদে, সিটি ও পৌর করপোরেশনে আসার ইচ্ছা পোষণ করা লোকের কথা ছিল জনতার দুয়ারে ভোট চাইতে যাওয়ার, কিন্তু এখন সেখানে যেতে হয় না। কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় তদবির করলেই মনোনয়ন আর সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই বিজয়। ‘রাজনীতিবিদ’ নির্বাচনী ইশতেহার কতটুকু জানেন? আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বিষয়গুলোর সঙ্গে তাঁদের অনেকের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়টাই ঘটেনি। এমন লোকেদের ‘রাজনীতিবিদ’ থাকার যুক্তিটা ঠিক কোথায়?

বিরোধী দমনের রাজনীতি কখনো রাজনীতি নয়। এটা বরং বিরাজনীতিকীকরণ। এই সর্বনাশা পদক্ষেপ খোদ আওয়ামী লীগকেই ফেলে দিয়েছে বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ায়। ‘রাজনীতিবিদ’ আজ রাজনীতি করছেন না, করছেন যোগ-বিয়োগের খেলা। এই বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় খোদ রাজনীতিটাই তো বিয়োগের অঙ্কে পড়ে গেছে। ফাঁকতালে দেশ চালাচ্ছে আমলাতন্ত্র।

কথা ছিল, দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থাকবে। থাকবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। অন্যথায় শাসক কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও অর্জনকে খেয়ে ফেলে। পরিস্থিতি এখন সেই দিকেই যাচ্ছে। গণতন্ত্র নির্বাসনের সাক্ষাৎ প্রতিফলন হচ্ছে, আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা। অভিজ্ঞতা, জবাবদিহি ও যোগ্যতাহীনতার কালে আমলাতন্ত্রই সরকার পরিচালনার প্রধান ভরসা।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’ গ্রন্থের রচয়িতা। [email protected]