
আমরা ঢাকায় থাকি। তাই আমাদের গর্ব এখন আকাশ ছোঁয়া, গগনচুম্বী।
অধমের নিবেদন—আমাদের সঙ্গে অন্য শহরের লোকদের সাক্ষাৎ হলে তারা যেন মাথাটা একটু নিচু করে, মাটির দিকে তাকিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। আমাদের এ শ্রদ্ধা ও সম্মান এখন প্রাপ্য। কারণ, দামেস্ক ছাড়া আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম শহরের ভীষণভাবে গর্বিত বাসিন্দা। সারা বিশ্বে আমাদের দ্বিতীয় স্থান কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না। ইদানীং বেশ কয়েকবার আমাদের স্থান ছিল দ্বিতীয়, যদিও মাঝে দু-তিনবার আমরা মেডেল তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছিলাম, অর্থাৎ তৃতীয় স্থানেরও দু-তিন ধাপ পেছনে চলে গিয়েছিলাম। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ তালিকায় আবার সিলভার মেডেল পেয়েছি। আহা, কী গর্ব!
সোনা জিততে পারিনি। এতে আফসোস নেই। যে নিকৃষ্টতম শহর হিসেবে সোনার মেডেল পেয়েছে, তার সাফল্যের তুলনায় আমরা একটু পিছিয়ে রয়েছি বৈকি। দামেস্ক শহরে যুদ্ধবিগ্রহ চলছে অর্ধযুগ ধরে। শুধু যুদ্ধ বলেই যুদ্ধ না। এই যুদ্ধে ছিল এবং আছে জঘন্যতম নৃশংস আইএস, আল-কায়েদা, অন্তত আধা ডজন আসাদবিরোধী বিদ্রোহী ও জঙ্গিগোষ্ঠী, ইরাক-তুরস্কে ভালো–খারাপ মিলিয়ে অন্তত তিনটি কুর্দি বাহিনী, আর পাড়া-মহল্লার রকেট, মেশিনগান ও হরেক রকমের অস্ত্রধারী স্থানীয় বিভিন্ন দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের গোষ্ঠী। আর বড় প্লেয়ার হিসেবে এই যুদ্ধে শরিক ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব। এত দিনের এত বড় যুদ্ধে তাই আমেরিকা ও রাশিয়া কোনোমতেই গরহাজির থাকতে তো পারে না। বিমানবাহিনী, মিসাইল, স্পেশাল ফোর্স ও আরও কত কিছু নিয়ে প্রচণ্ড দাপটে অংশগ্রহণ করছে এই পরাশক্তিগুলোও। ফিরিস্তি অনেক লম্বা, কারও নাম বাদ পড়লে সেটা অনিচ্ছাকৃত।
ফলাফল—কত হাজার নিরীহ নাগরিক এই যুদ্ধে মারা গেছে এবং মারা যাবে, তার সঠিক হিসাব কখনোই হবে না। প্রায় ১০ লাখ সিরিয়াবাসী এখন আশ্রয় পেয়েছে জার্মানিতে। তিরিশ লাখের বেশি আশপাশে তুরস্ক, জর্ডান, লেবানন, এমনকি ইরাকেও। ইউরোপের অন্যান্য দেশে আর কত হাজার বা লাখ সিরিয়ান পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে, তারও সঠিক তথ্য কখনোই মিলবে না। গোলা-বারুদ, বোমা, ট্যাংক ও বিমানবাহিনী ধুন্ধুমারে ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর, স্কুল বা হাসপাতাল, আবাসিক-অনাবাসিক এলাকায় উড়ে গেছে ব্রিজ-কালভার্ট, আহত শিশু-পুরুষ-নারী চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অবশ্য সরকার-সমর্থক কিছু কিছু লোক, গোষ্ঠী বা গোত্র বহাল তবিয়তেও আছে।
অতএব পাঠক, বুঝতেই পারছেন আমাদের থেকে নিকৃষ্টতর শহর হিসেবে বিশ্বতালিকায় স্থান পেতে হলে যুদ্ধবিগ্রহ, তা–ও আবার ভীষণ ধরনের যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আফগানিস্তানের কাবুল, ইয়েমেনের সানা বা লিবিয়ার ত্রিপোলির মতো টুকটাক ছোটখাটো যুদ্ধ বাধালেও আমাদের সঙ্গে রেসে পারবে না। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বেটারা বলেছেন, তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সূচকে আমাদের পয়েন্েট অনেক কম, প্রায় সবার থেকে সবকিছুতে আমরা নাকি পিছিয়ে। বেটারা অন্ধ। আমরা সুশীল সমালোচকদের মতো তাদেরও চোখে দেশ এবং ঢাকা শহরের মহা উন্নয়নের কিছুই বোধ হয় আমলে পড়েনি। যেমন এক শ বা ততোধিক বিশ্ববিদ্যালয়ওয়ালা কোনো শহর বিশ্বে আছে বলে অধমের জানা নেই। খোদ লন্ডন শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এক ডজনও পেরোবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এমন শহর হলো বোস্টন। গভীর অতীতে বোস্টনে ছিলাম বছর দুয়েক। যতই হিসাব করি গোটা দশেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কোনোমতেই মনে করতে পারছি না। কিন্তু পুনরাবৃত্তি করতেই হয় যে ঢাকা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন শতাধিক।
আর হাসপাতাল? ঢাকা শহরের শেরেবাংলা নগর এলাকার বিরাট বিরাট ‘বিশেষায়িত’ সরকারি হাসপাতাল আর সেই সঙ্গে আশপাশের শ্যামলী ও মোহাম্মদপুরের প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডিজিটাল ও প্যাথলজি ল্যাবরেটরি, ডাক্তারের চেম্বার ও ফার্মেসি—সব মিলিয়ে এই
এলাকাতেই যত চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে, ততগুলো প্রতিষ্ঠান দুনিয়ার বড় কোনো গোটা শহরে দেখেছি বলে কখনোই মনে হয়নি—দুনিয়ার অনেক শহরের নাম ভুলে গেছি।
এত কিছু করেও আমরা নিকৃষ্ট হলাম কেমন করে?
২.
অবশ্য তালিকাটি প্রকাশের পর শ্রদ্ধেয় মন্ত্রী মহোদয়দের অনেকেই তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই তালিকা বিএনপি-জামায়াতের গভীর ষড়যন্ত্রের ফল, সেটা বলেছেন কি না, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তাঁরা যা-ই বলুক বা না বলুক, সারা বিশ্ব জেনেছে এবং বুঝেছে ঢাকা থেকে দূরে থাকতে হবে। বায়ু খারাপ, পানি খারাপ, সড়ক-ট্রাফিকের অবস্থা বেহাল, পার্ক নেই, বিনোদন নেই—এমনকি দেখার মতো সিনেমা হলও গোটা দশেকের বেশি না। অনেকেই সন্দেহ করবেন যে এই শহরে ভেজাল ছাড়া কোনো খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হয় না। চিকিৎসা হয় ভেজাল ওষুধে।
রাসায়নিক পরীক্ষায় কী মাল-মসলা ব্যবহৃত হয়, তার কোনো হদিস কেউ রাখে না। ঈদে ঢাকা ছেড়ে যেতে হলে জীবন বাজি ধরতে হয়।
যদি টিকে থাকি, বেঁচে থাকি তাহলে তখন গর্বটা আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশের সমান উঁচু হবে।
৩.
দামেস্কের কথায় একটু ফিরে আসি। যত দূর মনে পড়ে গত বছর, হয়তো এই বছরের শুরুর দিকে হতে পারে, ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে বাশার আল–আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরেক টার্মের জন্য পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৫ আগস্ট প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ১০টি নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় দামেস্ক ও ঢাকার ওপরে যেই দেশগুলোর রাজধানী স্থান পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে ক্রমান্বয়ে নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, জিম্বাবুয়ে, লিবিয়া, ক্যামেরুন, আলজেরিয়া ও সেনেগাল। ‘কমন ফ্যাক্টর’ একটাই—আর তা হলো এই দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অবস্থা ‘অতি উত্তম’। এসব দেশে শুধু সরকারি দলের লোকেরাই সব সুযোগ-সুবিধা পায়। যেমন ২০ আগস্ট প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় খবর ছেপেছে ‘ঢাকার পশুর হাট আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের দখলে’ শিরোনামে। আর সড়ক
পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা দেখলেই বলেন, কোনো সংলাপ হবে না; কোনো দল নির্বাচনে আসবে কি না, সেটা সরকারের বা আওয়ামী লীগের মাথাব্যথা না।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকেও ১০ নিকৃষ্টতম শহরের তালিকা থেকে আমরা কোনোমতেই বের হতে পারব না। যে পথে আমরা চলছি সেই পথে ভালো কিছুর হদিস মিলবে না। ঈদ মৌসুমে টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে, আর বেশ কিছু ঘণ্টা বাস টার্মিনাল বা রেলস্টেশনে কাটিয়ে পথে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে আমরা ঢাকাবাসীরা দেশের বাড়ি যাই। এবং ফিরতি পথেও একই ভোগান্তি-যাত্রা। এটাই আমাদের কপাল।
পাদটীকা: লোকমুখে শুনেছি, কাগজপত্র কেউ দেখায়নি, তাই হলফ করে কথাগুলো সত্য, সেটা বলতে পারব না। যেটা শুনেছি তা হলো, ঢাকায় কোনো কোনো ইউরোপীয় দূতাবাসে কিছু কিছু শূন্যপদ থেকেই যাচ্ছে। ঢাকায় কেউই পোস্টিং চাইছেন না। অনেক বেশি বেতনের আশ্বাস সত্ত্বেও। আর ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ তালিকা প্রকাশের পর ঢাকায় তো আরও কম লোক আসতে চাইবে। আর যারা মূর্খের স্বপ্নরাজ্যে বাস করে, তারা আশা করতেই থাকবে যে এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হবে। গণতন্ত্র সুদৃঢ় হবে।
পাদটীকারও পরে শেষ কথা—সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এখন নিশ্চয় একটা নতুন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পেতে পারেন—নির্বাচনমন্ত্রী।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক