আমাদের ফুটবল ও বুড়িগঙ্গার জল

এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলে বাংলাদেশকে জর্ডানের গোলবন্যায় ভাসানোর খবরে মনে হলো বুড়িগঙ্গার জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। বুড়িগঙ্গা কেন, সে কথায় পরে আসছি।
জর্ডানের সাত গোল হজম করে তাজিকদের সঙ্গে টক্কর দেওয়াটাও জুতের হয়নি। বাংলাদেশি যুবারা প্রথমে এক গোল দিলেও শেষ পর্যন্ত একটা কম এক হালি গোল খেয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে। ফিলিস্তিনও ওই একই কাজ করেছে। আমাদের ফুটবল দল যখন বিদেশে খেলতে যায়, প্রতিবারই ভালো কিছু করার গালভরা বুলি শুনে আমরা আশায় বুক বাঁধি। স্বপ্ন দেখি—না, এবার আমাদের ছেলেরা কিছু একটা করে দেখাবে! কিন্তু স্বপ্নসাধের ঢাউস বেলুনটা ফটাস করে ফেটে যায়।
আমাদের দেশ মানবসম্পদে ভরপুর। এই সম্পদ বিপুল শ্রম দিয়ে বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে আসছে, যা দিয়ে আমরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালোভাবে খেয়েপরে দিন কাটাচ্ছি। এই সম্পদ রাতারাতি আকাশচুম্বী ইমারত গড়ে ফেলে, যা দিয়ে আমরা নগরসভ্যতার গর্ব করি। এই সম্পদ মাঠে মাঠে এমন ফসল ফলায়, যা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের আহার জোগাড় হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, পাহাড়ধস—কতশত বিপর্যয় ও বিপদে এই মানবসম্পদই অতুলনীয় সহায়তা করে থাকে। ১৭ কোটি মানুষের এই অপরিমেয় সম্পদের মধ্যে ফুটবল মাঠে বিজলির চমক ফোটানো ১১ জন তরুণ পাওয়া যাবে না—এটা ভাবতে খুব কষ্ট হয়।
ফুটবল দুনিয়ায় বাংলাদেশ আহামরি কিছু নয়। এরপরও আমাদের রয়েছে ঐতিহ্যময় ইতিহাস। পুরোনো দিনের কথা নাহয় বাদই দিলাম। স্বাধীনতা-উত্তর এই দেশে ফুটবল নিয়ে যে উন্মাদনা, উচ্ছ্বাস আর জমজমাট আয়োজন ছিল, ধারাটি এখন আর সে রকম নেই। ঢাকার ফুটবলে এখন সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, চুন্নু, রামা লুসাই, খুরশিদ বাবুল, বড় ইউসুফ, টুটুল, মহসিন, বাবলু, আবুল, আশরাফ, রকিব, হাসান, আশীষ ভদ্র, কোহিনূর, গাফফার—এঁদের মতো তারকা আর চোখেই পড়ে না। পরবর্তী সময়ে আরও যাঁরা এসেছেন, সেই সালাম, আসলাম, স্বপন, বাদল রায়, কায়সার হামিদ, ওয়াসিম, সাব্বির, রূপু, মোনেম মুন্না, এমিলি, মোস্তফা কামাল, মানিক, জোসি—এঁদের মতো দর্শকমনে নাড়া দেওয়া ফুটবল খেলোয়াড়ও নেই।
আগে ঢাকার ক্লাব ফুটবল লিগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টের অন্য রকম আকর্ষণ ছিল। মনে পড়ে, ১৯৭৮ সালে ঢাকায় আয়োজিত এশীয় যুব ফুটবলের মহাযজ্ঞের কথা। এশিয়ার সেরা দলগুলোর অনূর্ধ্ব-১৯ দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশ যুব দল জিতেছিল ইয়েমেনের বিপক্ষে। হাসান হেড করে একমাত্র গোলটি দিয়ে ‘জয়ের নায়ক’ বনে গেলেন। সিঙ্গাপুর ও বাহরাইনের সঙ্গে ড্র করাটাও ছিল চমক।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কুয়েতে এশিয়ান কাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলেছিল এশিয়ান সেরা ৮ দলের একটি হয়ে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ আর ভুটানের মতো দলগুলো তো বাংলাদেশের কাছে পাত্তাই পেত না। ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসে মালদ্বীপকে বাংলাদেশ ৮-০ গোলে হারিয়েছিল। এখন সেই মালদ্বীপের সঙ্গে খেলতে গিয়ে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস উঠে যায়। আগাখান গোল্ডকাপে খেলতে আসা বিদেশি নামীদামি ফুটবল দলগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের শীর্ষ স্থানীয় ক্লাব দলগুলো কম টক্কর দেয়নি। আগাখানে একবার ব্রাদার্স ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আর ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিপক্ষে আসলামের সেই ‘সাপের ছোবল’ হেডের গোলটি চোখে ভাসে এখনো। সে ম্যাচটি দক্ষিণ কোরিয়ার ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ দলের বিপক্ষে হলেও তা ছিল সে সময় তাদের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়দের নিয়ে গড় দল। দক্ষিণ কোরিয়ার সেই শক্তিশালী দলটিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ।
১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চারজাতি প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়ে। মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে মোনেম মুন্নার বাংলাদেশ জিতেছিল শিরোপা। ফাইনালে মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারিয়েছিলাম আমরা। এই মিয়ানমারই ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে হেরেছিল দুটি প্রীতি ম্যাচেই। দুটি ম্যাচেরই ফল ছিল ৩-১।
খুব আহামরি ফল বাংলাদেশের ছিল, সেটি বলা যাবে না। অনেক ম্যাচেই আমরা নাস্তানাবুদ হয়েছি। সাফ গেমসের ফুটবলে সোনা জিততে আমাদের আটটি আসর লেগে গেছে। কিন্তু আফগানিস্তান, মালদ্বীপ বা নেপালের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার মতো এমন দল ছিল না। ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়দের সাম্প্রতিক খেলা দেখে ‘থ’ বর্তমান বিদেশি কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ড। তিনি বলেছেন, এ দেশের ফুটবলাররা সহজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং মাঠে নামার আগেই হেরে বসে থাকেন। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০১৭)। বাংলাদেশের ফুটবলারদের বডি ফিটনেস বা শরীরের পারঙ্গমতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। সোজাসাপটাই বলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবধান গড়ে দেওয়ার মতো কোনো ফুটবলার বাংলাদেশে নেই। যারা আছে, তাদের মধ্যে ফুটবলের মৌলিক পাঠেই রয়েছে বড় ঘাটতি।
এ সমস্যা কিন্তু নতুন নয়। আমাদের দেশ ঘনবসতিপূর্ণ বলে আমরা অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে কম জনসংখ্যার দেশগুলোর চেয়ে অক্সিজেনসহ শরীর-সহায়ক উপাদানগুলো কম পেয়ে থাকি। পুষ্টিমানও অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। কাজেই আমরা শারীরিক সামর্থ্য ও দমে পিছিয়ে থাকি। কিন্তু লক্ষ্যে অটল থেকে অদম্য ইচ্ছা ও অনুশীলনে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, সেটি তো করা হয় না।
সরকারি বা বেসরকারিভাবে দেশজুড়ে বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট নেই, প্রকল্পভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেই, ফুটবল প্রতিভা অন্বেষণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেই। কাজেই দেশের ফুটবল চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বা বাফুফে বছর কয়েক আগে সিলেটে ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেও সেটি চালু রাখা যায়নি। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল, ব্রাদার্স, শেখ রাসেল ইত্যাদি বড় ক্লাবগুলোর নেই আগামীর তারকা তৈরির কোনো কার্যক্রম।
আমাদের দেশে এমন ছেলে পাওয়া বিরল, ছোটবেলায় যে ফুটবলে দু-চারটে লাথি না মেরে বড় হয়েছে। স্কুলের মাঠই বলুন, আর বাড়ির পাশের এক চিলতে খালি জমিই বলুন—ফুটবল মৌসুমে কোনোটাই কিন্তু খালি থাকে না। কিন্তু বড় হতে হতে অনেকেরই উৎসাহ ফিকে হয়ে আসে। সেটা পারিবারিক কারণে। কচি মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ফুটবল খেলে কিছু হবে না। ঘাড় গুঁজে বসে পড়তে হবে। তবেই ভবিষ্যতে ভাত জুটবে। এটা এমন এক সাঁড়াশি চাপ, যাতে অনেক ফুটবল প্রতিভা দিগ্ভ্রান্ত হয়। আর তাই এখানে পৃষ্ঠপোষকতার খুব প্রয়োজন। প্রতিভা খুঁজে বের করে তার সঠিক পরিচর্যা জরুরি।
প্রতিভার সদ্ব্যবহার আর পরিচর্যা কী কাজে লাগে, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল, বিশেষ করে কলসিন্দুরের মেয়েরা এর উজ্জ্বল প্রমাণ।
এখন বুড়িগঙ্গার সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই নদী এককালে দুগ্ধ-স্রোতস্বিনী ছিল। এর নিষ্কলুষ জলে মানুষ প্রাণভরে সাঁতার কেটেছে, জাল ভরে মাছ ধরেছে। যাত্রী আর মালামাল নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাচল করেছে নানা নৌযান। দিনের পর দিন নানা আবর্জনা ও কলকারখানার বর্জ্য ফেলায় সেই বুড়িগঙ্গার জল এখন দূষিত। শুকনো মৌসুমে নদীর কালো জলের ভয়ানক দুর্গন্ধে সেখানে শ্বাস টানা দায়। আমাদের ফুটবলের হতাশামগ্ন দুর্দশা যেন বুড়িগঙ্গার পচা জলের মতো। এই বিপন্ন নদীর মতো ফুটবলও চিৎকার করে বলছে, ‘আমাকে তোমরা আর মেরো না—বাঁচাও!’
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক, সাংবাদিক
[email protected]