আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি সৃজনশীলতার প্রতিকূল

প্রতীকী ছবি

শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বভাবতই শিক্ষক হিসেবে আমার ও আমার সহকর্মীদের সেটা ভাবিত করে। পেশার কারণে অনেক সাক্ষাৎকার ও নির্বাচনী বোর্ডে আমার থাকার সুযোগ হয়েছে।

২৩-২৪ বছর আগে একটি ব্যাংকের প্রোগ্রামার পদে নিয়োগের সাক্ষাৎকারে আমি ছিলাম। তখন বাংলাদেশে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক পর্যাপ্ত ছিল না বলে গণিত, পদার্থবিদ্যা, পরিসংখ্যান, রসায়নের স্নাতকেরাও এসব চাকরিতে আবেদন করতে পারতেন। সেই সাক্ষাৎকারে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পাস করা কোনো প্রার্থী ছিল না। আইবিএমএর পদ্ধতি অনুসরণ করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রার্থীর সাধারণ জ্ঞান এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা যাচাই করব। সাক্ষাৎকারে ৫০ জন প্রার্থীর সবাই ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম শ্রেণির স্নাতক। তাদের জন্য আমার এ রকম একটা প্রশ্ন ছিল, ‘এক ছাত্র বাসা থেকে ৬ কিলোমিটার দ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাল এবং ৪ কিলোমিটার দ্রুতিতে বাসায় ফিরল। গোটা ভ্রমণে তার গড় দ্রুতি কত?’ অনেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব কত?’ কেউ যানবাহনের প্রকারভেদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল; কেউ জানতে চাইল, যাওয়া–আসার ঘটনাটি সকালে না বিকালে ঘটেছে, ইত্যাদি। তবে কোনো প্রশ্ন ছাড়া যারা উত্তর করল তারা বলল গড় দ্রুতি ৫। আমি অনেককেই বললাম, এটা যদি ৪ আর ৬ এর গড় হতো তাহলে নিশ্চয়ই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির স্নাতককে জিজ্ঞাসা করতাম না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই উত্তর করতে কেউ এতটুকু সময় নিল না, ভাবল না প্রশ্নটি সম্ভবত এত সোজা নয়। এই যে বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করতে না পারা, সাধারণ জ্ঞানের নিদারুণ অভাবের ফলে প্রকৃত প্রশ্নে মনোযোগ না দিয়ে নানা অবান্তর প্রশ্নের চক্রে চাকরিপ্রার্থীদের চিন্তা আবর্তিত হওয়া— এর দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। তবে আবার এমন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত পেয়েছি যে সদ্য ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা এক ছাত্রী প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল। কিন্তু এটা প্রায় দুই যুগ আগের ঘটনা। তখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থ শক্তির অশুভ প্রভাবে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা লোপ পায়নি। দুই যুগ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্বাচনী মৌখিক পরীক্ষায়ও সেই প্রশ্নের উত্তরের পারফরম্যান্স আগের থেকে ভালো নয়।

চাকরিপ্রার্থীদের নির্বাচনী বোর্ড কিংবা কুইজ প্রতিযোগিতাগুলোতে আমি সুযোগ পেলেই বিশ্লেষণী, যুক্তিনির্ভর প্রশ্ন দিয়ে থাকি। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিচে তুলে ধরছি।

১. এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইজ প্রতিযোগিতায় উপাচার্য আমাকে অতিথি করেছেন। শুরুতেই আমি নিজের কিছু প্রশ্ন করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। দূরদর্শী উপাচার্য মহোদয় বললেন, রেগুলার কুইজ হওয়ার পর আমার সেশন হবে। রেগুলার কুইজে ছাত্রদের জ্ঞানের পরিধি দেখে আমি বিস্মিত হলাম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির মানের ক্রমোন্নতি হচ্ছে। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বেল বেজে উঠছে। কোনো প্রশ্নই শুদ্ধ উত্তরবিহীন যাচ্ছে না। ওই প্রশ্নগুলোর সিংহভাগের উত্তর আমার অজানা। এবার আমার পালা। ‘A বিন্দু থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে গিয়ে B বিন্দুতে পৌঁছলাম। B বিন্দু থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে C বিন্দুতে পৌঁছলাম। A থেকে C এর সর্বোচ্চ দূরত্ব কত?’ সব শিক্ষার্থীর সুইচ থেকে একসঙ্গে বেজে ওঠে বলার জন্য যে উত্তর শূন্য। আমি চৌকস শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তায় রীতিমতো অভিভূত।

২. এক নামী প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য মৌখিক সাক্ষাৎকার। বেতন-ভাতা আড়াই–তিন লাখ টাকা। প্রার্থীদের বয়স ৩৫ থেকে ৪৫। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি, আমার বেতন এর ধারে-পাশে না হলেও এ রকম দামি চাকরির নির্বাচনী বোর্ডে থাকা কম কথা নয়। আমি হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র নই, তবু তার কাছাকাছি একটি প্রশ্ন করলাম। ‘কমপক্ষে কত বছর বিনিয়োগ করলে ১০ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারের বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ হারে সরল সুদের থেকে শ্রেয় হবে?’ উত্তর এল, ফর্মুলা ব্যবহার করতে হবে। কাগজ–কলম এগিয়ে দিলাম। তখন বলা হলো, কম্পিউটার ব্যবহার করতে হবে। অবশ্য বোর্ডের একজন সম্মানিত সদস্যও কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমত হলেন। আমি আশ্বস্ত হলাম না। আমাদের হিসাববিজ্ঞানের বড় বেতনের কর্মকর্তারা এ রকম প্রশ্নের উত্তর করতে না পারলে কী করে আমরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব?

৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শাখায় মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের সাক্ষাৎকার। আমার প্রশ্ন: এক শিক্ষার্থী সিজিপিএ–৩.৪ নিয়ে ১০০ ক্রেডিট পাস করেছে। এবার আরও তিন ক্রেডিট কোর্সে তার গ্রেড পয়েন্ট হলো ৩.৫। তাহলে তার সিজিপিএ কত হবে? একজন বলল, উত্তর বের করতে ফর্মুলা ব্যবহার করতে হবে। কাগজ এগিয়ে দিলাম। কিন্তু সে উত্তর দিতে পারল না। আরেকজন বলল, সিজিপিএর পরিবর্তন হবে না। সবচেয়ে বুদ্ধিমান জনের উত্তর ৩.৪৫। ভাগ্যিস আর কোনো প্রার্থী ছিল না, যারা হয়তো ৩.৪–এর কম অথবা ৩.৫–এর বেশি বলত।

৪. ডিম বিক্রেতার কাছ থেকে ১০ টাকা করে ৮টি ডিম কিনলাম। ১০০ টাকা দেওয়ার পর ছেলেটি ডানে–বাঁয়ে দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করল। ৩–৪ মিনিট পর ক্যালকুলেটর এনে তা টিপে বলল ৮০ টাকা হয়েছে। ওই বয়সী ছেলে স্কুলে যাক আর না–ই যাক, এই হিসাব না পারলে আমাদের দেশ এগোতে পারবে না।

এই যে আমাদের চিন্তা না করার প্রবণতা, ধৈর্যের অভাব, এর অতি সত্বর পরিবর্তন আবশ্যক। যেকোনো দেশের স্বার্থ যেমন বিদেশিরা সংরক্ষণ করবে না, তেমনি আমাদের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। আমাদের দেশের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। এর জন্য চাই চিন্তাশীল প্রজন্ম, যারা মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো একটি উত্তর আগে দিয়ে পরে সময় থাকলে চিন্তা করার পথ ধরবে না।


মোহাম্মদ কায়কোবাদ: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো