
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর প্রায় সব ছাত্রছাত্রীর কাছে শুধুই ‘সিক’ স্যার—তাঁর নামের ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলো ধরে তাঁর এই নামকরণ। আমি যখন প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই, খুব গর্ব অনুভব করতাম আমি সিক স্যারের ছাত্র; তাঁর একটি ক্লাসেও কোনো দিন অনুপস্থিত থাকিনি। কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমানো আমার বন্ধু শান্তনু কায়সার তার এক লেখায় স্যারকে এই ছোট্ট নামে ডাকার একটা কারণ হাজির করেছিল। ‘যাঁকে নিয়ে অনেক কথা বলতে হয়, তাঁর নামটা ছোট হলেই সুবিধা,’ শান্তনু লিখেছিল, ‘আর যাঁকে নিয়ে কোনো কথা নেই, তাঁর নাম চল্লিশ অক্ষরের হলেই-বা কী।’ শান্তনুর আসল নাম ছিল আবদুর রাজ্জাক। সে অসাধারণ সুন্দর কিছু গল্প লিখেছে। স্যারের গল্পের সে অনুরাগী ছিল। একটু আক্ষেপের সুরে সে বলত, ‘স্যার যদি গল্প লেখায় আরেকটু সময় দিতেন...।’
শান্তনু ঠিকই বলেছিল, স্যারকে নিয়ে আমরা প্রচুর কথা বলতাম, এখনো বলি। কেন তিনি গল্প তেমন লেখেননি, তা নিয়েও আমরা কথা বলি। কিন্তু শান্তনুকে আমি বলেছি, গল্প লিখে স্যার জগদ্বিখ্যাত হলেও বাঙালি সমাজের যতটা উপকার হতো, তার থেকে বেশি উপকার তিনি করেছেন তাঁর মননশীল লেখালেখি দিয়ে; তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়ে; সংবাদপত্রে সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখা তাঁর মনোগ্রাহী কলামগুলো দিয়ে। তিনি কৃতী শিক্ষক; সমাজের নানা সংকটে তিনি পথপ্রদর্শক, তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। পশ্চিমে যাদের পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বলে, তিনি ষোলো আনা তা–ই। সমাজকে যারা পেছনে টেনে নিতে চায়, তাদের প্রতিরোধে তিনি অকুতোভয়। তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়াটা জীবন বদলে দেওয়ার মতো একটি অভিজ্ঞতা।
আজ স্যারের ৮১তম জন্মদিন।
কী পরিপূর্ণ আর সমৃদ্ধ একটি জীবন! কত জীবনকে তিনি স্পর্শ করেছেন, সঞ্জীবিত করেছেন; কত মানুষকে তিনি উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, কত শিক্ষার্থীকে সত্য আর সুন্দরের পথ দেখিয়েছেন, সেই হিসাব হয়তো তাঁর কাছেও নেই।
আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপহার ছিল আমাকে উৎসর্গ করা তাঁর একটি বই, দুই যাত্রার এক যাত্রী, যা বেরিয়েছিল ২০০৮ সালে। আত্মজৈবনিক একটি লেখা, কিন্তু স্যারের সব লেখার মতো এ বইতেও আছে মানুষ, সমাজ ও সময় নিয়ে তাঁর অসাধারণ কিছু বিশ্লেষণ। এই বইয়ের এক জায়গায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এক শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন—যাঁকে আমিও কিছুদিন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম—‘বিলেত থেকে তিনি ফিরেছিলেন পুঁজিবাদে তাঁর আস্থাকে দৃঢ়তর করে, কিন্তু তাঁর ভেতরে বিরাজ করছিল সামন্তবাদী অন্ধকার।’ আমার দুঃখ অনেক পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়েও ওই শিক্ষক মানুষের স্বপ্ন ভালোবাসার বিষয়গুলো ধরতেই পারেননি। তুলনায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন—এখনো আছেন—জ্যোতির্ময় একজন মানুষ, অন্যদের আলোর পথে আনাটাই যাঁর প্রধান কাজ। পুঁজিবাদ আর সামন্তবাদকে প্রতিহত করার দীক্ষা দেওয়াটা তিনি তাঁর শিক্ষকতার অংশ হিসেবে ধরে নিয়েছেন।
এ জন্য স্যার যখন ডি এইচ লরেন্স বা জোসেফ কনরাডের উপন্যাস পড়াতেন, সাহিত্যের আনন্দের পাশাপাশি জীবন আর শ্রেণি-সংগ্রামের ইতিহাস, পুঁজিবাদ আর উপনিবেশবাদের আগ্রাসন আর মানুষের মৌলিক পরিচয়গুলো নিয়ে কিছু পাঠ আমাদের জন্য তোলা থাকত। কলেজে থাকতেই মার্ক্সবাদ আমাকে এবং আমার অনেক বন্ধুকে আচ্ছন্ন করে রাখত; স্যারের সান্নিধ্য পেয়ে মার্ক্সবাদের ভেতরের মন্ত্র আর শক্তিগুলো আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। আমরা জেনেছি, মানুষ মানুষের জন্য, এবং গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল হওয়াটা দেশ ও ইতিহাস আমাদের কাছে দাবি করে।
তাই বলে যাকে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বলে, অধ্যাপক চৌধুরী কখনো তা দেখাননি। তিনি পল্টনে বা বটতলায় বক্তৃতা করেননি, রাজপথের মিছিলে যাননি, পুলিশের জলকামানের সামনেও পড়েননি। কিন্তু তাঁর কথা শুনলে আমাদের কী করণীয়, তা নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা থাকত না। মানুষকে অনুপ্রাণিত করার এক আশ্চর্য শক্তি তাঁর আছে। অনেক ভেবে আমি বুঝতে পেরেছি এর কারণ দেখা এবং দেখানোর ব্যাপারে তাঁর সততা। জীবনকে তিনি যে দৃষ্টি দিয়ে দেখেন তা মৌলিকভাবেই জীবনবাদী; মানুষকে তিনি যেভাবে দেখেন তার মূলে আছে মানবতাবাদে তাঁর অবিচল আস্থা। তিনি ইতিহাসের নিবিষ্ট পাঠক। যে বইটির কথা ওপরে উল্লেখ করেছি, তাতে নিজের জীবনের ইতিহাস তিনি লিখেছেন, একটি বদলে যেতে থাকা সমাজের ইতিহাস নিয়েও লিখেছেন। কিন্তু তাঁর নির্মোহ বর্ণনার পেছনে আমরা ঠিকই অনুভব করি কোথায়, কোন জায়গায় মানুষ নিয়ে, সমাজ-পরিবর্তন নিয়ে তাঁর আবেগ স্পন্দমান। তিনি বুদ্ধিকে ব্যবহার করেন শাণিত অস্ত্রের মতো—বুদ্ধি দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন, বিশ্লেষণ করেন; কিন্তু আবেগকেও তিনি নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন না। যদি
পৃথিবীটা বদলাতে হয়, তাহলে আমাদের বুদ্ধি আর আবেগের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। সূক্ষ্ম একটি ভারসাম্য। ডব্লিউ বি ইয়েটস তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন, শুধু আবেগ থাকলে তা ফুরোতে সময় লাগে না। কিন্তু আবেগটা মাথায় ধারণ করলে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
স্যারের ক্লাস করার অভিজ্ঞতাটা ছিল এ রকম এক ভারসাম্যের সন্ধান পাওয়ার মতো। তিনি সারা জীবন মানুষের কাজকর্মে এই ভারসাম্যের সন্ধান করেছেন। এই ভারসাম্যকে না নষ্ট করে যেমন—পুঁজির শাসন, অথবা সামন্তবাদ, অথবা যেকোনো উগ্র পন্থা—তার পরিচয়টি তিনি তাঁর লেখালেখিতে পূর্বাপর তুলে ধরেছেন। মানুষের অধিকার যারা খর্ব করে, অথবা স্বীকারই করে না, তারা একটা অন্ধ আবেগ থেকে তা করে, এবং তার মূলে বিষয় ও স্বার্থচিন্তা। তিনি পরার্থপরতাকে মানুষের মুক্তির একটি চাবিকাঠি হিসেবে দেখেছেন, যেমন দেখেছেন আত্মশক্তিকে। তিনি বিশ্বাস করেন, তরুণেরা যদি যথাযথ শিক্ষা পায়, তাদের আত্মশক্তির বিকাশ হবে।
আমরা জানি এবং দুই যাত্রার এক যাত্রী আমাদের জানায়, স্কুলজীবন থেকেই তিনি লেখালেখি করছেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পর লেখালেখিটা বাড়ল এবং কলম তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার অস্ত্র হয়ে দাঁড়ালে তিনি বিরতিহীন লিখেই চলেছেন। বাঙালি সমাজ তাঁর প্রিয় একটি বিষয়—এ সমাজের পিতৃতান্ত্রিকতা এবং এতে নারীদের অবস্থান নিয়ে তিনি ভেবেছেন। যখন শেক্সপিয়ারের নারীদের নিয়ে লিখেছেন, দেখলাম বাঙালি সমাজ নিয়ে তাঁর যে অন্তর্দৃষ্টি, তারই আলোকে যেন তিনি লেখাটি সাজিয়েছেন। সাহিত্যকে তিনি কল্পনার একটি স্বয়ম্ভূ অঞ্চল হিসেবে দেখেন না—সাহিত্য, মার্ক্সের সেই তত্ত্বের মতো আরও অনেক কিছুর মতো দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক একটি ভিত্তির ওপর। সেই অর্থনীতিটা না বদলালে সমাজে সাম্য আসবে না। সাহিত্যকে সমাজ, শ্রেণি, ক্ষমতা, পুঁজি ও নানা শক্তির আন্তসম্পর্কের আলোকে পড়তে হবে, যেহেতু সাহিত্য—একেবারে পরোক্ষে হলেও—সেসবকে ধারণ করে।
অনেক সময় তাঁর সামনে বসে সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে তাঁর অনেক বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, তাঁর দৃষ্টিটা দূরবিস্তারী, তাঁর চিন্তাও। এ জন্য সমাজের তৃণমূল থেকে নিয়ে শিখরের জীবনটা তিনি সমান দক্ষতায় পড়তে পারেন, দেখতে পারেন এবং আমাদের দেখাতে পারেন।
স্যার এখন শিক্ষকতায় সক্রিয় নন, কিন্তু তাঁর লেখালেখি দিয়ে সে কাজটি করে যাচ্ছেন। তাঁর কলম সৃষ্টিশীল ও
গতিশীল থাকুক।
শুভ জন্মদিন, স্যার।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।