আমাদের 'ভোঁতা বিবেক'

শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল) ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রকাশক-লেখক সম্পর্ক। সে সুবাদে তিনি যে কতটা নিখাদ উদার মনের একজন সেটি না বলে আমি কোনোভাবে নিবন্ধের শিরোনামের প্রসঙ্গে যেতে পারছি না। ২০১১ সালের কথা। পত্রিকায় মাঝে মাঝে লেখালেখি করি। সে সুবাদে আমার অর্ধশতাধিক লেখা জমা হয়েছে। বন্ধুদের পরামর্শে প্রকাশিত লেখাগুলোর একটি সংকলন প্রকাশ করার সাধ একদিন আমার মনেও জাগল। আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি এককথায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার টুটুল ভাইয়ের কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। একদিন গুটি গুটি পায়ে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় (ঠিক মনে নেই) শুদ্ধস্বরের অফিসে গিয়ে হাজির হই। টুটুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি প্রথম সাক্ষাতে আমার সঙ্গে যে আন্তরিকতা নিয়ে কথা বললেন এবং আমাকে বই প্রকাশের ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন, এতে আমি বুঝে গেছি আগামী বইমেলায় আমার বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে! এবং হয়েছেও তাই।
একই দিনে দৃর্বৃত্তদের হাতে খুন হলেন লেখক-প্রকাশক জাগৃতির স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন এবং আহত হলেন শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরীসহ দুজন ব্লগার-লেখক। প্রকাশক দীপন হত্যা ও তিন লেখক-প্রকাশককে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে ১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদতলে ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী লেখক ও নাগরিকবৃন্দ’-এর ডাকে এক বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সকালে টিভির স্ক্রলে এ সংবাদ দেখে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে একটু আগেই বেরিয়ে পড়ি। পরে অফিস থেকে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির চত্বরে সকাল ১০টার আগেই পৌঁছাই। পৌঁছে টিএসসির পরিবেশ দেখে মনে হলো দেশে কোথাও কিছুই ঘটেনি! সবকিছু স্বাভাবিক। বেলা পৌনে ১১টার দিকে কলাভবনের দিক থেকে ৩০-৪০ জন ছাত্রছাত্রীর একটি মিছিল রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে গেল, এরপরে মাইক সচল হলো। আমিও মাইকের আওয়াজে সমাবেশের সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। একে একে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের বক্তারা আসতে শুরু করলেন।
কিন্তু সমাবেশ শুরুর পর থেকে আমার বিবেককে যে বিষয়টি বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল সেটি হলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশক হত্যা ও হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ সমাবেশে ১০০ ছাত্রও প্রতিবাদ জানাতে এলেন না কেন! আমাদের ‘বিবেক’ ‘অনুভূতি’ কি তাহলে এতটাই ভোঁতা হয়ে গেছে? ২৪ ঘণ্টাও পেরোয়নি, মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটাপথ দূরত্বে আজিজ সুপার মার্কেটে একজন মুক্তমনা মানুষ দিনদুপুরে খুন হলেন, অথচ আমাদের প্রতিবাদের ক্ষোভটুকু এর মধ্যে নিভে গেল! দীপন, আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন!
পরে অবশ্য বিভিন্ন মহল থেকেই প্রতিবাদ হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে অাধা বেলা হরতালও হয়েছে। এখনো প্রতিবাদ হচ্ছে।

>আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের মস্তিষ্ককে ভোঁতা করে ফেলছে। নইলে যে তরুণসমাজ বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তারা কেন আজ নীরব হয়ে পড়ছে?

আমরা বলছিলাম অতীতে সব আন্দোলনের সূতিকাগার নামে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। এর প্রতিটি আবাসিক হলে কম করে হলেও ৫০০ থেকে ৮০০ ছাত্রছাত্রী অবস্থান করেন। সেই হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী থাকার কথা। কেবল পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের জন্যই কি এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এসেছেন? আমাদের কি তাহলে এই কথা বিশ্বাস করতে হবে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিবেক জাগ্রত করতে পারেননি! সদ্য সন্তানহারা পিতা যখন সন্তানের মৃত্যুর বিচার না চেয়ে পুরো জাতির মুক্তির জন্য ‘শুভবুদ্ধির উদয়ের’ আহ্বান জানান তখন আমাদের মতো ‘ভোঁতা বিবেক’সম্পন্ন জীবদের মাথা নুয়ে পড়াটাও কম হয়ে যায় বৈকি!
বিচারহীনতার সংস্কৃতি একদিকে সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, রাহাজানির মাত্রাকে নীরবে প্রশ্রয় দিচ্ছে, অন্যদিকে নিত্যদিনের খুন, রাহাজানি আমাদের বিবেককে ঘুমিয়ে রেখেছে। কারও মৃত্যু আমাদের মন কাঁদায় না, বিবেককেও জাগায় না! পেট্রলবোমার আগুনে মানুষ ঝলসে যাচ্ছে, তাতে কী হয়েছে! ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে ঝলসানো গ্রিল, শিক কাবাব ছাড়া যে আমার ব্রেকফাস্ট করার ষোলো আনা পূর্ণই হয় না! মায়ের পেটের শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে তো কী হয়েছে, আমার দেশের ১৬ কোটি জনশক্তি আছে না! যাকে ইচ্ছা তাকে গুলি করব, বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে রিকশার ওপর গাড়ি তুলে দেব—কার বাপের সাধ্য আমাকে আইনের জালে আটকায়?
রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতি কতটা প্রকট হলে একজন সন্তানহারা পিতা সন্তান হত্যার বিচার চান না! আর কতটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হলে আমাদের হুঁশ হবে, আমাদের এবার জাগতে হবে! আর কত মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর আমরা জানব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হয়েছে! তাহলে কি ব্লগার, দেশি-বিদেশি নাগরিকেরা একে একে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র শিকার হতেই থাকবেন যতক্ষণ না সরকারের গায়ে তা না লাগে? আর সরকারের গায়ে লাগেনি সেটাই বা বলি কী করে? এই তো মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সন্ত্রাসীদের হাতে দুজন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন।
আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের মস্তিষ্ককে ভোঁতা করে ফেলছে। নইলে যে তরুণসমাজ বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তারা কেন আজ নীরব হয়ে পড়ছে? তবে সবাই যে নীরব নয়, সেটাও লক্ষ করি গত কয়েক দিনের কর্মসূচিতে। কিন্তু এই রুটিন প্রতিবাদ কর্মসূচি কিংবা প্রতিবাদকারীদের ক্ষীণকণ্ঠ সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করতে কিংবা রাষ্ট্র নামের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে পারবে কি?
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
[email protected]