আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়া কতটা সমীচীন

সুদের হারের সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির একটা বিপরীতমুখী সম্পর্ক আছে—এটি সবার জানা। সম্পর্কটা এ রকম, যদি সুদের হার বাড়ে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কমে। কারণ, বর্ধিত হারে সুদের কারণে ঋণ গ্রহণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে বলে মুদ্রাবাজারে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অর্থ সরবরাহ কমে গেলে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে যায়, ফলে তার দামও কমে আসে। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মটি কেবল চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদস্ফীতিতে এই তত্ত্ব অকার্যকর।

সুদের সংজ্ঞা কী? এই সংজ্ঞা দুই তরফে দেওয়া যায়। সঞ্চয়কারী নগদ অর্থ বর্তমানে ভোগ না করে ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে ভোগ করার জন্য রেখে দেয়। বর্তমানের ভোগ বিসর্জন এবং ভবিষ্যতে ভোগের জন্য অপেক্ষার মূল্য হিসেবে প্রত্যাশিত বাড়তি আয়—এই দুটো মিলেই হয় সঞ্চয়ের ওপর সুদ। আবার ঋণের বিপরীতে সুদের সংজ্ঞা অন্য রকম। ঋণ হচ্ছে গ্রহীতার মূলধন, যা বিনিয়োগ করে উৎপাদন বা ব্যবসা করা যায়। সুতরাং মূলধনের উৎপাদনক্ষমতা আছে বলেই ঋণগ্রহীতাকে তার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, সেটাও সুদ। এই দুই ভিন্ন ক্ষেত্রে সুদের সংজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য আছে বলে মনে হলেও আসলে নেই। কারণ, সঞ্চয়কারীকে যে সুদ দেওয়া হয়, সেটিও আসে সেই সঞ্চয় বিনিয়োগের প্রাপ্তি থেকে, যা ঋণ হিসেবে বিতরণ করে ব্যাংক। তাহলে দুই তরফের সংজ্ঞাকে একীভূত করে বলা যায়, আর্থিক মূলধন ব্যবহারের জন্য যে মূল্য দেওয়া হয়, সেটিই সুদ।

বাংলাদেশে ব্যাংকঋণের সুদের বিষয়ে ব্যবসায়ী মহলের নিরন্তর অনুযোগের ফলে ২০১৯ সাল থেকে এই হারের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ব্যবসায়ী মহলের যুক্তি ছিল যে ব্যাংক সুদের উচ্চ (?) হারের কারণে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। শিল্পোদ্যোক্তা মহলের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতের তরফ থেকে আশা ও দাবি করা হয়েছিল, বাণিজ্য ও শিল্প খাতে সুদের হার কমানো হলেও অনুৎপাদনশীল ভোক্তাঋণের সুদের হার যাতে কমানো না হয়। বলাবাহুল্য তাতে কোনো ফলোদয় হয়নি। ব্যাংকগুলোকে যখন ঋণের ওপর সুদের ঊর্ধ্বসীমা মানতে বাধ্য করার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন অর্থনীতিবিদদের অনেকেই সুদের হারের ওপর জবরদস্তি না করে সেটাকে বাজারের স্বাভাবিক ধর্মের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে সময় সরকারি নির্দেশে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে ধার্য করার কথা বলা হলেও ব্যাংকগুলো তা বাস্তবায়ন করতে গড়িমসি করছিল। অবশেষে বিস্তর টানাপোড়েনের পর ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এই নির্দেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে বছর শেষে সুদের গড় হার কমে দাঁড়ায় ৮.৩০ শতাংশে।

আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণের ওপর সুদের বিষয়টি এখন এককভাবে ব্যাংকের হাতে কিংবা বাজারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে এই সুদের নিম্নগতিকে ধারণ করার জন্য আমানতের ওপর সুদ ব্যয় কমাতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়ে পড়ে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সুদের হারের সম্পর্ক।

এই নির্দেশ মানতে গিয়ে মুনাফা ধরে রাখার জন্য ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদের হার কমাতে শুরু করলে অনেকেই প্রমাদ গুনছিলেন। কারণ, আমানতের ওপর সুদের হার কমলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত অবসরপ্রাপ্ত আমানতকারীরা। দেশে কোভিড-১৯ মহামারির তাণ্ডবে স্থবির বিনিয়োগের ফলে তারল্য ভারাক্রান্ত ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ঋণের সুদহার সরকার নির্দেশিত ৯ শতাংশের নিচে নামাতে শুরু করে। এই প্রবণতা আরও একবার প্রমাণ করে, সুদের হার নির্ধারণ করার জন্য কোনো জবরদস্তির প্রয়োজন হয় না। ক্রমহ্রাসমান ঋণ সুদের হারের সঙ্গে আমানতের ওপর সুদের হারের নিম্নমুখী গতিও অব্যাহত থাকে। ফলে অবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হয়, যাতে আমানতকারীদের স্বার্থহানি না ঘটে। এই নির্দেশে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের ওপর মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম সুদ দিতে পারবে না।

আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণের ওপর সুদের বিষয়টি এখন এককভাবে ব্যাংকের হাতে কিংবা বাজারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ফলে এই সুদের নিম্নগতিকে ধারণ করার জন্য আমানতের ওপর সুদ ব্যয় কমাতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়ে পড়ে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সুদের হারের সম্পর্ক। মুদ্রাস্ফীতি ঘোষিত সুদ থেকে সংগোপনে আয় সরিয়ে নেয় বলে প্রকৃত সুদের হারই কেবল কমে না, আসলের ওপরও হাত পড়ে। যেমন মুদ্রাস্ফীতির গড় হার যদি ৫ শতাংশ এবং আমানতের ওপর ঘোষিত গড় সুদহার ৪ শতাংশ হয়, তাহলে বছর শেষে আমানতকারীর প্রকৃত সুদের হার (৪-৫= ১) কমে গিয়ে মূল আমানত থেকে উল্টো ১ শতাংশ খেয়ে ফেলবে।

অর্থাৎ এক বছর আগে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য কেনা যেত, এখন সুদ ও আসল মিলিয়েও সে পরিমাণ পণ্য কেনা যাবে না, কারণ এক বছর আগের এক শ টাকার মূল্য এখন নিরানব্বই টাকা। সুতরাং আমানতের ওপর সুদের হার যদি মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে কম হয়, তাহলে ব্যাংকে আমানত রাখা লোকসানে পরিণত হবে। কিন্তু পরিহাসের মতো শোনালেও সত্য, যে আমানতকারীদের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে ব্যাংক মুনাফা করে, তাদের তুলনায় বহু গুণ বেশি লভ্যাংশ ঘরে তোলে ব্যাংকে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা।

মধ্যবিত্ত ও সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমানতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সুদের নিম্নসীমা কার্যকর করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে একাধিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। অতিরিক্ত তারল্য ঘোচাতে নামিয়ে আনা ঋণের সুদহারের বিপরীতে মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি আমানত সুদহার প্রয়োগ করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফার প্রবৃদ্ধি হবে নিম্নগামী, তাই ঋণের সুদের হার আবার ফিরিয়ে আনতে হবে ৯ শতাংশে। আবার আমানতের ওপর বর্ধিত সুদের হারের কারণে বিনিয়োগ স্থবিরতার মধ্যে দেখা দেবে বাড়তি তারল্যের সংকট। সেটি সামাল দিতে গিয়ে হয়তো বিভিন্ন বাহানায় ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আমানত নিরুৎসাহিত করা হবে। তখন ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত তারল্য থেকে উদ্ধার করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে তুলে আনতে হবে বাজারের উদ্বৃত্ত সরবরাহ।

মুদ্রাস্ফীতি ও পণ্যমূল্য, সুদের হার ও টাকার ক্রয়ক্ষমতা, তারল্য ও বিনিয়োগ সবকিছুর এক কঠিন ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকিং খাতকে। সুতরাং আমানতকারীদের ব্যাংক সুদের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য শেয়ার ও বন্ডবাজার চাঙা করা, পেনশন স্কিম ইত্যাদি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু করতে হবে। এ কথা ভুললে চলবে না, ব্যাংকের কাজ কেবল আমানতকারীদের সুদ আয় নিশ্চিত করা নয়, বিনিয়োগে অর্থায়নের বিভিন্ন উৎসের মধ্যে মধ্যস্থতা করাই ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব। কারণ, ব্যাংকও অন্য সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতোই একটা প্রতিষ্ঠান, যাকে শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে হয়।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

[email protected]