আমার কন্যাশিশুটি কবে নিরাপদ থাকবে?

আমার কন্যাশিশুটি কবে নিরাপদ থাকবে? ছবিতে ছোট্ট দেহখানি দেখার পর থেকেই মনের ভেতর এ প্রশ্নটি কেবল বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটি স্কুল থেকে দুপুরের খাবার খেতে বাড়িতে এসেছিল। জুমে কাজ করতে যাওয়ার আগে শ্রমজীবী মা হয়তো হাঁড়ির তলায় একটুখানি খাবার রেখে গিয়েছিলেন! কিন্তু সেটুকুও কি মুখে তুলে নেওয়ার সুযোগ ছোট্ট মেয়েটি পেয়েছিল?

হ্যাঁ, পিতৃহারা কৃত্তিকা ত্রিপুরা পূর্ণার কথাই বলছি। বয়স ১০ ছুঁইছুঁই। পড়ত চতুর্থ শ্রেণিতে, স্থানীয় নয়মাইল সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। উচ্ছলতা এখন যার নিত্যসঙ্গী হওয়ার কথা ছিল! গত ২৮ জুলাই খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নয়মাইল এলাকায় নিজ বাড়ির কাছেই নৃশংসভাবে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে মেয়েটি। ঘাতকদের চোখ এতটাই হিংস্র লালসায় মত্ত ছিল যে এই ছোট্ট মেয়েটির নিষ্পাপ মুখটি দেখেও একবারের জন্য মায়া হয়নি!

বর্তমানে পাহাড় কতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে, এই ছোট্ট মেয়েটির ওপর চালানো নির্যাতন থেকেই সহজে অনুমান করা যায়। নরপশুরা শিশুটিকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা শিশুটির শরীর বীভৎস কায়দায় ক্ষতবিক্ষত করে নারকীয় বিকৃত লালসা চরিতার্থ করেছে। আমরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার কোথায় চাইব! কার কাছে চাইব! যেখানে স্কুল শিক্ষার্থীদের বাস পিষিয়ে মারে, বাসের যাত্রীর মুখ থেঁতলে দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় নদীতে ছুড়ে মারা হয়, পিতার মৃত্যুর আর্তনাদ শুনে সন্তান মোবাইল ফোন আঁকড়ে ধরে থাকে, সন্তানহারা পিতা মেয়ের বাস চাপা পড়ার জায়গায় বসে অঝোরে কাঁদেন—এ দেশে কোথায়, কোন কোনায় গিয়ে দাঁড়ালে এমন খবর থেকে মুক্তি পাব! পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে—এসব অনাচার, অন্যায়ের বিচার চাইতে কার কাছে যাব, সেটাও ভুলতে বসেছি!

চলতি বছরের গত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সীতাকুণ্ড, রাউজানে পাহাড়ি নারীর ওপর যে আক্রমণ, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সংকটময় ও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে, তার প্রমাণ মেলে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুই মারমা তরুণীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা, ২৭ জানুয়ারি রামগড়ে এক পাহাড়ি নারীকে (৪৫) ধর্ষণ ও গলাটিপে হত্যার চেষ্টা, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মাটিরাঙ্গায় ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণ, ১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুকছড়ি থেকে দুই নারীনেত্রীকে অপহরণ, ১৩ এপ্রিল বান্দরবানের আলীকদমে ত্রিপুরা কিশোরীকে গণধর্ষণ, ১৮ মে সীতাকুণ্ডে দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণের পরে হত্যা, ১৭ জুন বান্দরবানের লামায় নিজ বাড়িতে মারমা কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা, ২১ জুন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্কে এক কিশোরীকে গণধর্ষণ, ৫ জুলাই চট্টগ্রামের রাউজানে বৌদ্ধমন্দিরের অনাথ আশ্রমে এক মারমা কিশোরীকে হত্যা, ৯ ও ১৭ জুলাই কাউখালী ও মহালছড়িতে দুই পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা। এই নারকীয় তাণ্ডবের সর্বশেষ শিকার দীঘিনালার নয়মাইল এলাকার ছোট্ট মেয়ে পূর্ণা ত্রিপুরা।

কেবল নারীর ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যার ঘটনা নয়; পার্বত্য চট্টগ্রামে গত সাত-আট মাসে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর বিভিন্ন সময়ে হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। কিন্তু এসব অরাজকতা, রাহাজানি বন্ধে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়ে না।

পাহাড়ে একের পর এক নারী ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। পাহাড়ে সংঘটিত এই ঘটনাগুলোকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার অবকাশ নেই। এযাবৎকালের যত নারী নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর কোনোটির দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি না। ২২ বছর আগে কল্পনা চাকমা অপহরণের কথাই বলি কিংবা সুজাতা-তুমাচিং হত্যার বিচারের কথা বলি, এসব অপরাধের বিচারের মুখ পাহাড় দেখেনি। দু-একটা মামলা ডিসমিস হলেও সেগুলোতে অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পেয়েছে। তাই পাহাড়ে বিশাখারা ধর্ষণের শিকার হয়, সবিতা চাকমারা খেতে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারায়। কিন্তু ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ইব্রাহিমরা জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার ধর্ষণ করে। সুজাতা, সবিতা, তুমাচিং, পূর্ণারা ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হবে, আমাদের মা-বোনেরা ঘাতকদের দ্বারা পথেঘাটে যত্রতত্র লালসার শিকার হবে—এটাই যেন পাহাড়ে চাপিয়ে দেওয়া সরকারের নীতি।  

এখন মনের মধ্যে যে ভাবনাটি ঘুরেফিরে আসে তা হচ্ছে, আমার নিষ্পাপ ফুটফুটে কন্যাটি কবে নিরাপদে মুক্ত আকাশ-বাতাসে মুক্তির শ্বাস নিতে পারবে! শুনলাম পুলিশ ইতিমধ্যে পূর্ণার ঘাতকদের আটক করেছে। ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়েটিকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু তার ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেখতে চাই। একই সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের মানবিকতার চোখগুলো একদিন পাহাড়ে ভোরের আলোর মতন ফুটবে—সেই ক্ষণটির অপেক্ষায় বুকে এখনো আশা বেঁধে রাখি!  

ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক