আমার ছোট কাকা

দ্বিজেন শর্মা
দ্বিজেন শর্মা

সম্প্রতি এক টিভি চ্যানেলে আমার ছোট কাকা দ্বিজেন শর্মার একটি সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে অতীত স্মৃতির আকর্ষণে ছুটে গেলাম মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার নিভৃত পল্লি ‘শিমুলিয়া’য়, যেখানে আমি ও আমার ছোট কাকা একই বছরে (১৯২৯) ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম। এ গ্রামের তরুপল্লবের ছায়ায় আমাদের যে শৈশব স্মৃতি লুকিয়ে আছে, তা খুঁজতে লাগলাম সাতাশি বছরের জীবনসন্ধ্যায়। আজ ছোট কাকার জন্মদিন।
মায়ের কাছে শুনেছি, আমি ও ছোট কাকা যখন শিশু, তখন আমার দুই দাদু পাশাপাশি দুই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। আমাদের যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য তিন পুরুষের কবিরাজি পেশা। দুই বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুনসহ বিভিন্ন বৃক্ষ এবং অশোক, শিউলী, কামিনী, অপরাজিতা, গন্ধরাজসহ বিভিন্ন প্রকার ফুলের বিপুল সমারোহ ছিল। সেসবের ছায়ায় ছুটির দিনের অধিকাংশ সময় আমরা হেসেখেলে কাটিয়েছি। ফুলও কুড়িয়েছি প্রচুর, সাথি ছিলেন আমার পিসিমা সন্ধ্যা রানী ও আমার জ্যাঠাতো বড় বোন অম্বুজা (কুটু/বুড়ি)। নিসর্গের ঋতুবৈচিত্র্য আমাদের দেহ-মনে পুলক জাগিয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই ছোট কাকা ছিলেন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। মাথাভর্তি ছিল একরাশ ঘন কালো চুল, দৃষ্টি বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল। আমার বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘ভস্মলোচন’। বাড়ির অন্যরা ডাকতেন ‘খোকা’। শুধু তাঁর বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ডাকতেন ‘খোকামণি’। চন্দ্রকান্ত শর্মা কবিতা লিখতেন, ছিলেন একজন গ্রন্থপ্রেমিক। বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ গ্রন্থ ও প্রধান পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে বাড়িতে একটা গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। নিস্তব্ধ দুপুরে বই ছাড়া তাঁকে আমি কখনো দেখিনি। অসুস্থ হলে খোকামণিকে ডেকে বলতেন, ‘আলমারি থেকে অমুক বইটি এনে আমার শিয়রে বসে পড়, আমি শুনি।’ আমরাও পড়াশোনার ফাঁকে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তাম। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাদলা দিনে আমরা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দীনেন্দ্র কুমার রায়ের রহস্য উপন্যাসের মাঝে ডুবে যেতাম।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত নিকড়ি নামে পাহাড়ি খরস্রোতা ছোট্ট এক নদী। নদীটি ছিল আমাদের ছেলেবেলার একান্ত এক সঙ্গী। এখনো স্মৃতিপটে জ্বল জ্বল করছে বর্ষায় পূর্ণযৌবনা উন্মাদিনী এ স্রোতস্বিনীর ভয়ংকর ও মোহিনী রূপ। নদীটি এখন লুপ্তির পথে। নদীহারা শিমুলিয়া যেন তার এক মমতাময়ী দুলালীকেই হারিয়ে ফেলেছে।
আমার আর ছোট কাকার বিদ্যারম্ভ হয়েছিল আমাদের গ্রামের আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক প্রয়াত নীরদ চন্দ্র শর্মা ছিলেন সুপণ্ডিত, তাঁর শাসন ছিল খুবই কড়া। পাঠে অমনোযোগী হলে প্রচুর কায়িক শাস্তি দিতেন। অন্যদিকে কৃতী ছাত্রদের ভালোবাসতেন প্রাণভরে। ছোট কাকা ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। তিনি প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবেও তিনি সুপরিচিত।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে আমরা দুজন বড়লেখা পি সি হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়য়ের দূরত্ব পঁাচ কিলোমিটার। আমরা ও গ্রামের তিন-চারজন ছাত্র রেললাইন ধরে স্কুলে যেতাম। হাত ধরাধরি করে যে লাইনটির ওপর দিয়ে আমরা চলে যেতাম, তার নাম ছিল ‘এবিআর’। ছোট কাকা বলতেন, ‘বলো তো, এ লাইনের নাম কী?’ আমরা বলতাম ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’। তিনি হেসে কৃত্রিম ডাঁট দেখিয়ে বলতেন, ‘হলো না, এবিআর। মানে হলো, আমার বাবার রেল!’
ছোটবেলা থেকেই ছোট কাকা রসনাবিলাসী ছিলেন। বাড়িতে মাংস রান্না হলে তাঁর ঘন ঘন রান্নাঘরে যাওয়া বেড়ে যেত। আমার বড় ঠাকুরমা (ছোট কাকার জ্যাঠিমা) ছিলেন একজন বৈষ্ণবী। তাই বৎসরব্যাপী আমাদের বাড়িতে মহাপ্রভুর বিভিন্ন অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। বছরের বিশেষ মাস হলো নিয়ম মাস (কার্তিক)। সে মাসে বিশেষ উপাচারে বাল্যভোগ দেওয়া হতো। ঘন দুধের সর, দুটি কুলবতী কলা ও শর্করা সহযোগে তৈরি বাল্যভোগ পূজা শেষে ছোট কাকার জন্য বরাদ্দ থাকত।
ছেলেবেলায় তিনি যথেষ্ট ডানপিটে ছিলেন। আমরা গ্রামের জঙ্গলে ঢুকে পিচুণ্ডি, লুকলুকি, ভুবি, ডেফল, জলপাই প্রভৃতি ফল প্রচুর খেয়েছি। ফল খেতে খেতে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাও চলত। আমরা গ্রামের অন্য সাথিদের নিয়ে ফুটবল, হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা প্রভৃতি খেলা অনেক খেলেছি। ফুটবল খেলার প্রতি তাঁর খুব ঝোঁক ছিল, খেলতেনও ভালো।
আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কাপড়, কেরোসিন, লবণসহ আরও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখা দেয়। লেখার কাগজের দুষ্প্রাপ্যতা হেতু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়া অন্য সব পরীক্ষা মৌখিকভাবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ ঘোষণার পর ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রের মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ মৌখিক পরীক্ষায় তারা অভ্যস্ত নয়। ছোট কাকা পরীক্ষার দিন চেঁচিয়ে বললেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমার পরীক্ষা তো আগেই হবে। সে-সময় আমি চেঁচিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেব আর তোমরা শুনে শুনে সেভাবে প্রস্তুতি নেবে। এভাবে ক্লাসের সবাই প্রথম দিনের বাংলা পরীক্ষায় পাস করেছিল।
আমাদের পাশের গ্রামের মাঝিপাড়ার বৃন্দাবন মাঝি আমাদের ছেলেবেলার আর এক মধুর স্মৃতি। পেশিবহুল দীর্ঘদেহী লোকটির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু সে রামায়ণ, মহাভারত, পদ্মপুরাণসহ বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক শুনে শুনে আয়ত্ত করেছিল। তার আরেক পেশা ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে জ্বালানি কাঠ চেরাই করা। এ কাজের জন্য সে আমাদের বাড়িতেও আসত। আমরা তখন খুব খুশি হতাম। আমি, ছোট কাকা ও আমার পিসিমা সন্ধ্যা রানী পান-সুপারি দিয়ে তাকে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলার জন্য চেপে ধরতাম। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনার এমন রসময় বর্ণনা দিত যে আমরা মনশ্চক্ষে সেসব ঘটনা যেন সত্যি সত্যি দেখতে পেতাম।
আমাদের ছেলেবেলার একটি নিত্যকর্ম ছিল শীত মৌসুমে বিকেলে গোঠ থেকে গরু নিয়ে আসা। আমরা বেলা তিনটা–সাড়ে তিনটায় কুল, লবণ, ধনেপাতা ও কাঁচা লঙ্কা নিয়ে পড়ন্ত রোদে মাঠে যেতাম। খেলার সাথিদের সঙ্গে নিয়ে সেসব খেতাম, খেলাধুলা করতাম। খেলা শেষে অস্তাচলগামী সূর্য পেছনে রেখে আমরা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
তারপর অনেক বছর চলে গেছে। মহাকাল আমাদের উভয়ের সর্বাঙ্গে বার্ধক্যের নামাবলী পরিয়ে দিলেও ছোট কাকার ভাবনার জগৎ আজও প্রকৃতি ও মানব প্রেমের মাধুর্যে উদ্ভাসিত। তাঁর কর্মমুখর উচ্ছল জীবন আজও আমার জীবনে প্রেরণা জোগায়।
রবীন্দ্র কুমার শর্মা: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নেত্রকোনা, নিউটাউন।