আমার দুঃখিনী বর্ণমালা

নিজ বাসভূমেই ক্রমাগতভাবে অবহেলা আর অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ জেগেছিল, যে সাংস্কৃতিক উজ্জীবন ঘটেছিল, তার ধারাবাহিকতা চলছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রথম সাড়ে তিন বছরের শাসনকালেও এর ধারাবাহিকতা ও ইতিবাচক অগ্রগতি ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু দুঃখজনক যে সেই আবেগকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অব্যাহত রাখতে পারিনি। বরং পরবর্তীকালে আবেগের আনুষ্ঠানিকতা শুধু বলবৎ থেকেছে; মর্যাদার আসন থেকে আমরা মাতৃভাষাকে ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিয়ে অবজ্ঞার তিমিরে নিক্ষেপ করেছি।

প্রথম আঘাতটি এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঘটনাসূত্রে। রাতারাতি ‘রাষ্ট্রপতি’ হয়ে গেলেন ‘প্রেসিডেন্ট’, ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে গেল ‘রেডিও বাংলাদেশ’। ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকেরা বাংলা ভাষার মর্যাদাবিরোধী চেতনাকেই পরিপুষ্ট করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সূচনা এ সময় থেকে।

১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছু ঘটনা ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের মধ্য দিয়ে এক পরাশক্তির পৃথিবী সৃষ্টি, পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী রূপসহ নতুন ঔদ্ধত্যের প্রকাশ, সেই সঙ্গে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির সীমাহীন বিস্তার বিশ্বকে এক নতুন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেলে বেড়ে যায় ইংরেজির দৌরাত্ম্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত থাকতে তো পারিইনি; উপরন্তু এর সর্বাত্মক ক্ষুধার কাছে আমাদের অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার লাভের পরিণামে দেশে বেড়েছে আরবির প্রাধান্য; অন্যদিকে একই সঙ্গে হিন্দি সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, মধ্যপ্রাচ্যীয় সংস্কৃতি ও হিন্দি সংস্কৃতির যুগপৎ আক্রমণে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শিকার হচ্ছে সীমাহীন অবজ্ঞা ও অবহেলার। বাস্তবে এর ক্ষেত্রগুলোকে নিম্নোক্তভাবে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বাংলা মাধ্যমের বিপরীতে ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে বিপুলভাবে।

দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে রয়েছে অনীহা।

তৃতীয়ত, অবজ্ঞা ঘটছে সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে।

চতুর্থত, বিকৃতির মাধ্যমে একধরনের অবজ্ঞার ব্যাপকতা ঘটছে প্রচারমাধ্যমে: ক) বেতার-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা থেকেই ঘটছে বিকৃতি। গত কয়েক বছরে বিপুলভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বেসরকারি টেলিভিশন-বেতারে লোকরঞ্জক উপস্থাপনার নামে মূলত এ বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টত হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল ও হিন্দি উপস্থাপকদের আচরণ-উচ্চারণ ব্যাপকভাবে প্রভাব রাখছে। নাটকের ভাষায়ও পড়ছে এর ক্ষতিকর প্রভাব। খ) অন্যদিকে ছাপা সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, আদর্শগত অবস্থানের চেয়ে বিভিন্ন করপোরেট হাউসের ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রসার লাভ করায় পত্রিকার একটি বড় অংশ বাংলা ভাষার মান বজায় রাখার প্রশ্নে সতর্ক নয়।

পঞ্চমত, নতুন প্রযুক্তি হিসেবে সামাজিক মাধ্যমে ভাষার যে বিকৃতি সাধিত হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব। ভাষা গতিশীল, পরিবর্তনশীল, বিবর্তনশীল এবং বিশুদ্ধতার কোনো মাপকাঠি নিয়ে ভাষা স্থির হয়ে নেই—এ কথা মান্য করেও বলা যায়, সামাজিক মাধ্যমের ভাষাবিকৃতি কোনোভাবে যুক্তিসিদ্ধ নয়।

ষষ্ঠত, বিকৃতির ঘটনা ঘটছে নানা পর্যায়ের সাইনবোর্ড তৈরি ও নামকরণের ক্ষেত্রে। দোকানপাট, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতির নামকরণের ব্যাপারে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ব্যাপক। বসবাস ও ব্যবসার জন্য নির্মিত সুউচ্চ ভবনের নামকরণের ব্যাপারেও বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব সর্বাত্মক। সর্বত্রই নিজ দেশ, নিজ ভাষা, নিজ মাটি, নিজ সংস্কৃতি ও নিজ ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের ক্ষমাহীন অভাব।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি জুটলেও বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর বিষয়টি এখনো সুদূরপরাহত। দিন দিন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার পরিধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকুচিত হচ্ছে। তার ওপর ঘটছে বিরামহীনভাবে বিকৃতির নৈরাজ্য। সুতরাং বাংলা ভাষার অগ্রগতি ও বিকাশকে বাধাহীন ও সর্বব্যাপক করতে হলে ভাষা নিয়ে আরেকটি আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজন ক্রমেই তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে

কেন ঘটছে বাংলা ভাষার প্রতি এ অবজ্ঞা? এ বিকারের উৎসবিন্দু কী? এ ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণকে স্পষ্টত চিহ্নিত করা যায়।

যেমন প্রথমত, উপনিবেশবাদ আমাদের মধ্যে যে হীনম্মন্যতার প্রবেশ ঘটিয়েছে—অর্থাৎ নিজ দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনতার বোধ—তার পালা এখনো চলছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষা আমাদের চেতনায় বদ্ধমূল করেছে যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিই উন্নত। আজ বিশ্বায়নের পটভূমিতে ইংরেজির আধিপত্য এবং নিজ ভাষা সম্পর্কে হীনতার বোধ দুই-ই সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে। এখানে অর্থনৈতিক প্রশ্নটিও মারাত্মকভাবে বর্তমান। একসময় এ অর্থনৈতিক প্রশ্নেই আমরা উর্দুর বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাষার পক্ষে জীবনপণ লড়াই করেছি। আর এখন চাকরির জন্য, জীবিকার জন্য, উন্নত জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর জন্য ইংরেজি ভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিখতে হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, হিন্দি সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল ও হিন্দি চ্যানেলগুলোর প্রচারণা এমন এক সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে যে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ তা দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ওই ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেছে। আধিপত্যও বাংলা ভাষাকে ক্রমেই কোণঠাসা করছে। তৃতীয়ত, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিরও একটি দায় আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা যথার্থভাবে শিক্ষাদান করতে পারছি না, যা মাতৃভাষার প্রতি শিক্ষার্থীকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে।

তৃতীয়ত, আরও আছে অসচেতনতা। নিজ মাতৃভাষা শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে ব্যাপকভাবে। জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য সৃষ্টি, গবেষণা কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে নিজেকে উপস্থাপন প্রভৃতির জন্য মাতৃভাষাকেও যে একটি বিদেশি ভাষার মতো সমান গুরুত্ব দিয়ে শিখতে হয়, এ ধারণার অভাব সমাজে ব্যাপক। ভুল মনে হলেও অভিধান ব্যবহারের শ্রম স্বীকারে প্রতিনিয়ত আলস্যবোধের কারণে ভুলটি মজ্জাগত থেকে যায়; এটাও অবজ্ঞাপ্রসূত।

চতুর্থত, আমাদের সমগ্র জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান আঞ্চলিকতা দোষ। এর সংশোধনের জন্য মান ভাষা রপ্ত করার দিকে যে পরিমাণ মনোযোগ, উৎসাহ ও আগ্রহ প্রয়োজন, তার অভাবও পীড়াদায়ক।

সবশেষে বলব, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি জুটলেও বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর বিষয়টি এখনো সুদূরপরাহত। দিন দিন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার পরিধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকুচিত হচ্ছে। তার ওপর ঘটছে বিরামহীনভাবে বিকৃতির নৈরাজ্য। সুতরাং বাংলা ভাষার অগ্রগতি ও বিকাশকে বাধাহীন ও সর্বব্যাপক করতে হলে ভাষা নিয়ে আরেকটি আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজন ক্রমেই তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।


সৈয়দ আজিজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক