আমার রোল মডেল নাজমা চৌধুরী

১১টা বাজতে মাত্র ১০ মিনিট বাকি। ফকিরাপুলের যানজটে পড়ে ক্লাস মিস হওয়ার উপক্রম। ‘মকবুল ভাই, দ্রুত গাড়ি চালান, কিছুতেই মিস করা যাবে না.চৌ-এর ক্লাস।’ তিনি ভীষণ পাঙ্কচুয়াল, ঘড়ির কাঁটা ধরে ক্লাসে ঢোকেন। এক মিনিট এদিক-সেদিক হয় না। না.চৌ মানে ড. নাজমা চৌধুরী। বিভাগে এভাবেই ছিল তাঁদের নামকরণ। ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর স্যার পরিচিত বো.খা.জা হিসেবে, ড. শামসুল হুদা হারুন স্যার পরিচিত শা.হু.হা হিসেবে, আর সৈয়দ মকসুদ আলী স্যার পরিচিত ছিলেন স.ম.আ হিসেবে। ১৯৮১ সালের কথা বলছি। আমার এক মাসের ছোট্ট রাশাদকে কোলে নিয়ে ছুটছি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। রাশাদ থাকবে গাড়িতে পরিচর্যাকারীর সঙ্গে। ক্লাস শেষে পরিচিত শিক্ষকের বাসায় তাকে দুধ খাইয়ে আবার ফিরব ক্লাস করতে। এতই আকর্ষণ না.চৌ-এর ক্লাসের!

কলা ভবনের ৪০৩১-এ তাঁর ক্লাস। সদ্য সিজারিয়ানের কষ্ট নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় পৌঁছে দেখি রোল কল শেষ। কানে এল তাঁর গম্ভীর কিন্তু ভীষণ মিষ্টি কণ্ঠস্বর। পড়াচ্ছেন লুসিয়ান পাইয়ের উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক সংকট। বৈধতার সংকট, অংশগ্রহণের সংকট, জাতীয় সংহতির সংকট ইত্যাদি। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি তাঁর লেকচার। পাতার পর পাতা ভরে যায় ক্লাস নোটে।

আমার বাসাসুদ্ধ সবাই জানে কি দারুণ পড়ান এই না.চৌ! তাঁর হাঁটাচলা সবকিছুতে এমন এক মার্জিত শিক্ষকের মূর্তি যে শ্রদ্ধায় মাথা এমনিতে অবনত হয়ে আসে। কখনো তেমন সাজেন না তিনি। তাঁত বা কোটার টান টান মাড় দেওয়া শাড়ি পরেন। ষাটের দশকের নায়িকাদের মতো আঁচলটা ছোট এবং তা সযত্নে সামনে টানা। কখনো সরতে দেখিনি সে আঁচল। মাঝখানে সিঁথি করা পরিপাটি চুলগুলো ছোট্ট খোঁপায় বাঁধা। নিরলংকার এই শিক্ষিকা বাঁ হাতের অনামিকায় শুধু থাকে নয়টি হিরের ডায়মন্ড শেপের একটি আংটি। পরে জেনেছি, ওটা তাঁর বিয়ের আংটি।

প্রথম বর্ষে তাঁকে পেয়েছি টিউটোরিয়াল শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তী বছরে পড়িয়েছেন ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাস, তৃতীয় বর্ষে সাতচল্লিশ-উত্তর পাকিস্তানের রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়। প্রথম বর্ষের ছাত্রী থেকে বিভাগীয় সহকর্মী হিসেবে কোন দিক দিয়ে কেটে গেল ৪৩টি বছর। কদিন আগে তাঁর মেয়ে ও মেয়ের জামাই বুশরা বাপ্পি জানাল তাদের ছেলে আবরাজ জর্জটেকে পড়তে যাচ্ছে। নাজমা আপা নাকি ভীষণ খুশি! কিন্তু হায়, কদিন পরে আবার ফোন এল, আপা কোভিডে আক্রান্ত।

স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি। গতকালের খবর ছিল, আপা আরোগ্যর দিকে। আমার সবটুকু স্বস্তি উড়িয়ে দিয়ে, আজ ৮ আগস্ট সকাল সাড়ে আটটায় তাঁর সব যুদ্ধ সমাপ্ত করে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন আমার এই প্রিয় শিক্ষক—নাজমা আপা। হ্যাঁ, নাজমা আপা আর নেই। হারানো শিক্ষকদের তালিকায় তিনি আরেকটি সংখ্যা যোগ করলেন। এ বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ড. এমাজউদ্দীন, ড. বি কে জাহাঙ্গীর, ড. সাইফুল্লাহ ভূঁইয়া ও সামসুল হক স্যার।

নাজমা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৬৩ সালে। এই স্বল্পভাষীর সঙ্গে কত-না সময় কেটেছে ডিপার্টমেন্টের মিটিংয়ে টিচার্স লাউঞ্জে আর তাঁর বাড়িতে। ছোট ছোট করে শুনেছি কত না-বলা গল্প। ১৯৬৬ সালে তিনি যখন কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পিএইচডি করছিলেন, তখন নাকি মাদাম তুসো মিউজিয়ামের সামনে এক ছাত্র দৌড়ে এসে দাঁড়াল। ‘ম্যাডাম, আপনি এখানে! আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি আপনার ছাত্র।’ আপা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেন, তাঁকে চেনানোর জন্য ছাত্রটি বলেছিল, ‘ম্যাডাম, সেই যে কথা বলার জন্য আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন, মনে পড়ে? আমি সেই মাসুদ।’ নাজমা চৌধুরীর কাছে শাস্তি পাওয়াটাও যেন একটা ভাগ্যের ব্যাপার!

নাজমা আপার কাছে আমি কতভাবেই না ঋণী। ১৯৮৪ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই, বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। আমার সিলেকশন কমিটিতেও ছিলেন তিনি।

আশির দশকের শুরু থেকে ড. নাজমা চৌধুরী জেন্ডার স্টাডিজের প্রতি ভীষণভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল আমি জেন্ডার স্টাডিজে পিএইচডি করি। তবে আমার ভালো লাগা ছিল অন্যদিকে। তাতে একটুও মনঃক্ষুণ্ন হননি তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁর এবং বারবারা নেলসনের সম্পাদনায় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। বইটি পরবর্তী সময়ে ভিক্টোরিয়া চাক পুরস্কার অর্জন করে। ২০০০ সালে তিনি এবং আরও কিছু শিক্ষক মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। আমার কিন্তু খুব রাগ হয়েছিল। কেন ছাড়তে হবে নাজমা আপাকে? রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের যে খুব ক্ষতি হয়ে গেল।

ড. নাজমা চৌধুরী ভালোবেসে বিয়ে করেন মইনুর রেজা চৌধুরীকে। দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধাবোধে মুগ্ধ হতাম মাঝেমধ্যেই। মইনুর রেজা চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসর নেন কিন্তু আক্রান্ত হন মরণব্যাধি ক্যানসারে। একই সময়ে আমার স্বামী আবরারের রেটিনাল ডিটাচমেন্টের অপারেশনের জন্য আমরাও ছিলাম সিঙ্গাপুরে। আপাকে দেখেছি কি যত্নে সেবা করছেন স্বামীর।

তিনি সব সময় বলতেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীর পেশাগত অর্জন শুরু তাদের ৪০ পেরোনোর পরে। সন্তান উৎপাদন ও পরিচর্যার দায়িত্ব তখন কমে আসে, নারী তার সৃষ্টিশীলতার বিকাশে মন দিতে পারে। তিনি বলতেন, ‘আমার কথাই ধরো, আমার বিয়ের পরপর আমার শাশুড়ি মারা যান। আমার ছোট দেবরের বয়স তখন দেড় বছর। বিশাল পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছি, নিজের দুই মেয়ের শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছি, তার পরেই নিজের দিকে তাকিয়েছি।’ ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় নিভৃতে বিচার বিভাগের সহায়তায় ডিভোর্স এবং সন্তানের কাস্টোডি বিষয়ে কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটান নাজমা আপা। ২০০৮ সালে তিনি ভূষিত হন একুশে পদকে।

খুব অল্প বয়সে পারকিনসন্স তাঁর শরীরে বাসা বাঁধলেও সে অসুখ তাঁকে ক্ষান্ত করতে পারেনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর ছিল কাজ করে যাওয়ার দুরন্ত স্পৃহা। না-ফেরার দেশে ভালো থাকুন আমার নাজমা আপা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সব ছাত্র-শিক্ষকের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই কৃতজ্ঞতা।

তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।