আমি যা লিখছি, আপনারা তার কী বুঝলেন

স্কুলগুলো বন্ধ ছিল অনেক দিন। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলগুলো আবারও চালু হলো। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি দেওয়া হয়েছিল স্কুল খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা ফিরে এসেছে। শিরোনাম: ১৮ মাস পর ক্লাসে ফেরার আনন্দ। কৌতুকের ফেসবুক পেজ ইয়ার্কি তা–ই নিয়ে রসিকতা করেছে: সংবাদপত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্কুল-কলেজে আনন্দ করেছে ‘ছেলেরা’।

তাদের এই রসিকতা দেখে আমার মুখের কোণে আপনা-আপনিই হাসি উঠল ফুটে। সত্যি, সংবাদপত্রের ছবি দেখলে মনে হবে, এসএসসি পরীক্ষা দেয় শুধু মেয়েরা। হল বন্ধ করে দেওয়া হলে বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগ টানতে টানতে হল ছাড়ে শুধু মেয়েরা। পরীক্ষার ফল দিলে জিপিএ–ফাইভ পেয়ে আনন্দ করে শুধু মেয়েরা।

স্কুল খোলা নিয়ে ফেসবুকে বেশ কিছু রসিকতা দেখতে পেলাম। একজন বলছেন, আমার ভাগনি ভুলে গেছে সে কোন ক্লাসে পড়ত। একজন লিখেছেন: কী আজব ব্যাপার। টিকা দেওয়া হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, আর খুলে দেওয়া হলো স্কুল! যঁাদের মনে এই ধরনের প্রশ্ন এসেছে, তাঁদের মনের ভেতরে আসলে আছে কী? কী আছে, সেটা ভালো করেই জানেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি জাতীয় সংসদে বলেছেন, আন্দোলনের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে না, এই কথা সত্য নয়। অবশ্যই আন্দোলনের ভয় পেলে সরকার স্কুলও খুলত না। কারণ, আমাদের মনে আছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরাই বড় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিশোর বিদ্রোহ বলে তা ইতিহাসে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

স্কুলে ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই মাস্ক পরে থাকছে। শিক্ষকেরাও মাস্ক পরেই থাকছেন। প্রশ্ন হলো, স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে কী হবে? তখন কি ছেলেমেয়েরা মাস্ক না পরেই খাবে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর হলো, টিফিন খাওয়ার সময় ছেলেমেয়েরা মাস্ক খুলেই খাবে। প্রশ্ন হলো, খাওয়ার সময় মাস্ক খোলা হলে তখন কি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় থাকবে না? উত্তর হলো: থাকবে। কিন্তু অল্পক্ষণ মাস্ক খুলে থাকলে শরীরে অল্প পরিমাণে ভাইরাস ঢুকবে, বেশিক্ষণ খোলা থাকলে বেশি পরিমাণে ঢুকবে। করোনাভাইরাস যত বেশি ঢুকবে, সংক্রমণের তীব্রতা তত বেশি হবে। অতি অল্প পরিমাণ ভাইরাস ঢুকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তি তাদের দমন করে ফেলতে পারবে।

এত দিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে। বহু শিশু চিরদিনের জন্য স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। শিশুশ্রম বেড়েছে। বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে সাংঘাতিকভাবে। ইউনিসেফ বারবার করে বলেছে, স্কুল খুলে দিন। কোনো একটা দেশে করোনা প্রতিরোধে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হওয়া উচিত শেষ পদক্ষেপ। কিন্তু বহু দেশ স্কুলগুলোকে বন্ধ করে রাখাকেই ভেবেছে প্রথম কর্তব্য।

একটা অনলাইনে পাওয়া কৌতুক নিজের মতো করে পরিবেশন করি।

জন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে বললেন, ন্যান্সি, আমি ছুটি কাটাতে যাচ্ছি মিয়ামি বিচে। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? এক সপ্তাহ থাকব। পুরো খরচ আমার। তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গ এবং সমুদ্রসৈকত দারুণ উপভোগ করবে।

ন্যান্সি তখন বললেন তাঁর স্বামী মিল্টনকে, মিল্টন, আমি অফিসের কাজে এক সপ্তাহের জন্য ট্যুরে যাচ্ছি। তুমি একদম লক্ষ্মী হয়ে থাকবে, ঠিক আছে। মিল্টন তখন বললেন তাঁর বান্ধবী মারিয়াকে—মারিয়া, আমার বউ তো এক সপ্তাহ থাকবে না। এই একটা সপ্তাহ কি তুমি আমার সঙ্গে কাটাতে পারো না? আমরা একটা সপ্তাহ নিজের মতো করে আনন্দে কাটাব।

মারিয়া তখন বললেন তাঁর ছাত্র ববকে—বব, আমি এক সপ্তাহ তোমাকে পড়াতে পারব না। তুমি এই এক সপ্তাহ তোমার নিজের মতো করে কাটাও। বব তখন বলল তার বাবা জনকে—বাবা, আমার টিচার এক সপ্তাহ আসবে না। আমি কি তোমার সঙ্গে মিয়ামি যেতে পারি না?

জন তাঁর ছেলের এই আবদার এড়াতে পারবেন না। তিনি তাই বললেন ন্যান্সিকে—ন্যান্সি, আমার মিয়ামি বিচে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়ে গেছে। ন্যান্সি বললেন মিল্টনকে—লক্ষ্মীটি তোমার জন্য সুখবর, আমার অফিসের ট্যুর ক্যানসেল হয়ে গেছে। মিল্টন বললেন মারিয়াকে—মারিয়া, আমার বউ অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে না।

মারিয়া বললেন ববকে—বব, আমি তোমাকে পড়াতে আসব। আমার জরুরি কাজটা আর নেই! বব গিয়ে বলল বাবা জনকে, বাবা, আমার টিচার আমাকে পড়াতে আসবেন। তোমার সঙ্গে আমি এক সপ্তাহ কাটাতে পারব না। জন তখন বললেন ন্যান্সিকে—ন্যান্সি, আমি বিচে যেতে পারব! এই চক্র চলতেই থাকবে। শেষে মারিয়া বলবে—বব, আমি এক সপ্তাহ তোমাকে পড়াতে পারব না। তখন আবার বব বলবে বাবা জনকে—বাবা, আমি এক সপ্তাহ তোমার সঙ্গে কাটাব।

করোনাভাইরাস এই সাইকেল বা চক্রের মতো। আমরা নিয়ম মানব। ঘরে থাকব। মাস্ক পরব। করোনার প্রকোপ কমে আসবে। তখন আমরা বাইরে বেরোতে থাকব। বাইরে বেরোতে শুরু করলেই করোনা আবার মাথাচাড়া দেবে। তখন আবার আমরা গৃহবন্দী হব। আবার করোনা কমে আসবে। তখন আবার বাইরে যাব। বাইরে গেলেই করোনার প্রকোপ বাড়বে। তখন আবার আমরা ঘরবন্দী হব।

এই গল্পটা দাঁড়াবে হোর্হে লুইস বোর্হেসের গল্পের মতো। গল্পের নাম ‘স্বপ্ন’। ইরানের একটা মরুভূমিতে অনুচ্চ একটা স্তম্ভের নিচে একটা সেলে (নোংরা গোলাকার তার মেঝে) একটা টেবিলে একজন বন্দী একটা কবিতা লিখছে। সেই কবিতায় আমার মতো দেখতে একটা লোক একটা কবিতা লিখছে, যাতে অনুচ্চ একটা স্তম্ভের নিচে একটা সেলে (নোংরা গোলাকার তার মেঝে) একটা টেবিলে একজন একটা কবিতা লিখছে। সেই কবিতায় আমার মতো দেখতে একটা লোক একটা কবিতা লিখছে...এই প্রক্রিয়া কখনো শেষ হবে না এবং কেউ কোনো দিনও পাঠোদ্ধার করতে পারবে না কবিতায় বন্দী আসলে কী লিখছে...

আমরা বোর্হেসের গল্পের চরিত্রটির মতোই বন্দী। আমরা কী লিখছি, কেউ কোনো দিন তার মর্মোদ্ধার করতে পারবে না। আমি এখন যা লিখছি, আপনারা কি তা বুঝছেন? বুঝলে অনলাইনের মন্তব্যের ঘরে একটু লিখবেন?

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক