আমিও টিকা নিতে চাই

এইটা কিন্তু কৌতুক না। আমি সিরিয়াস। আমি সবার আগে সবার সামনে করোনা প্রতিরোধক টিকা নিতে চাই। শুধু আমি যে নিতে চাই তা-ই নয়, আমার প্রিয়জনদেরও দিতে চাই।

আমি কেন নিতে চাচ্ছি। কারণ, আমি নিরাপদ থাকতে চাই। আমি এই পৃথিবীতে আরও কিছুদিন বেঁচেবর্তে থাকতে চাই। আমার পাশের টেবিলে বসা সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোটই ছিলেন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে
চলে গেছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমার আরও আরও নিকটাত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি করোনায় হারিয়েছি। খুব ঘনিষ্ঠ স্বজনকে আইসিইউতে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলায় থেকে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখেছি। তাঁরা ফিরে এসেছেন, কিন্তু কোভিডের দখল তিন মাস, ছয় মাস পরেও তাঁদের শরীর-মন থেকে যাচ্ছে না। টাকাপয়সা, সময়, স্নায়ুর ক্ষয় তো আছেই।

প্রথম আলোয় বিবিসির খবর থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে: কোভ্যাক্সিন একটি ‘নিষ্ক্রিয় টিকা’, যার অর্থ এটি তৈরি করা হয়েছে মৃত করোনাভাইরাস থেকে। মানবদেহে এই টিকা নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। টিকা প্রয়োগের পর এটিকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মানবদেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে দেখা গেছে। চার সপ্তাহের ব্যবধানে দিতে হয় এর দুটি ডোজ। আর সংরক্ষণ করা যায় ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।

তবে এটা তো সত্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাস চীনে দেখা দেয়, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে টিকা এসে গেছে। ফলে, এই টিকা দিলে এক বছর পর কী হবে, পাঁচ বছর পর কী হবে, দশ বছর পর কী হবে, তা জানার জন্য যথাক্রমে এক বছর, পাঁচ বছর আর দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু নিরাপদ না হলে একটা টিকা কোটি কোটি মানুষকে দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেবে, এতটা উন্মাদ কি এই পৃথিবী আর তার মানুষ হয়ে গেছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপ বলছে, বাংলাদেশে ৮৪ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী। কিন্তু তার মধ্যে ৩২ শতাংশ এখন নিতে আগ্রহী, বাকি ৫২ শতাংশ পরে নিতে আগ্রহী। কখনোই টিকা নিতে চান না ১৬ শতাংশ মানুষ।

বাংলাদেশের মানুষের সুবিধা হলো, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে তাঁরা খুবই আগ্রহী, উদার। এই দেশে টিকাদান কর্মসূচির সফলতার কারণ হলো মানুষের এই গ্রহণ করার ক্ষমতা এবং আগ্রহ।

তবে টিকার বিরুদ্ধে প্রচারণাও আছে। এর পেছনে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, ভারতবিরোধিতা—নানা মনস্তত্ত্বও কাজ করছে। আমি আমার গত শুক্রবারের লেখায় ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক গবেষক ডা. রুহুল আবিদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে খানিকটা তুলে ধরেছিলাম। আজকে পুরোটাই উদ্ধৃত করি:

‘“ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,

চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,

ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা

অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।

আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

...আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা!”

‘টিকা এলে, টিকা পেলে, টিকা নিন। আগে স্বাস্থ্যকর্মী, সম্মুখ কাতারের কর্মী, বয়স্কদের টিকা নিতে দিন। তারপর নিজে টিকা নিন, অন্যকে নিতে উৎসাহিত করুন।

‘না জেনে, আধা জেনে, গুজব রটাবেন না। আকারে-ইঙ্গিতে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলে মানুষের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। ইতিহাস এ রকম গাদা গাদা মূর্খকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে মানবসভ্যতাকে এদ্দূর এগিয়ে এনেছে।

‘আপনিই প্রথম (মূর্খ) নন! আপনি যুগে যুগে ছিলেন, থাকবেনও—আপনাকে আমরা গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হওয়ার আগপর্যন্ত দেখেছি। এখনো দেখছি এবং দেখব, যতক্ষণ না মানব ইতিহাস করোনাকে ও আপনাকে অতীতের কোটরে নিক্ষেপ না করে।’

এরপর আর কথা চলে না।

যে ১৬ শতাংশ নিতে চান না, তাঁদের কারও কারও মনোভাব এই যে সবাই নিয়ে নিক, তাহলে তো আর আমাকে নিতে হবে না। এখানে রাজার পুকুরে এক ঘটি করে দুধ ঢালার গল্প মনে করুন। সবাই ভেবেছে, ওরা তো দুধ দেবে, আমি না হয় পানিই দিলাম। শেষে পুকুর ভরে উঠল শুধু পানিতে।

আমি টিকা নিতে চাই। টিকা নিয়ে ভারতের টুইটারে একধরনের কৌতুকের চল হয়েছে।

১. দম বিরিয়ানিতে টিকা মিশিয়ে দিন। হায়দরাবাদে সবার টিকা নেওয়া হয়ে যাবে।

২. পান মসলায় টিকা মিশিয়ে দিন। সারা ভারতে টিকা নেওয়া হয়ে যাবে।

৩. পানিপুরিতে টিকা মিশিয়ে দিন। অর্ধেক ভারতে টিকা নেওয়া হয়ে যাবে।

৪. মমতে টিকা মিশিয়ে দিন। দিল্লিতে সবার টিকা দেওয়া হয়ে যাবে।

৫. রসগোল্লায় টিকা মিশিয়ে দিন। কলকাতায় সবার টিকা দেওয়া হয়ে যাবে।

৬. চায়ে টিকা মিশিয়ে দিন। বিকেলের মধ্যে ভারত করোনামুক্ত হবে।


সবাইকে টেক্কা দিয়েছে রসিকতার সাইট ‘ইয়ারকি’। তারা বলেছে, ধুলার মধ্যে টিকা মিশিয়ে দিন, পুরা মিরপুরে টিকা দেওয়া হয়ে যাবে।

আমার ধারণা, ধুলার সঙ্গে টিকা মেশানো গেলে কেবল মিরপুরবাসী নয়, সারা দেশবাসীরও টিকা দেওয়া হয়ে যাবে।

কৌতুক থাকুক। আপনার পিতা-মাতাকে টিকা দিন। এরপর নিজে টিকা নিন।


আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক