আমেরিকা কি আবার বিশ্বের নেতা হতে পারবে

বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: এএফপি

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের আসন্ন অভিষেক এ আশার সঞ্চার করেছে যে তাঁর প্রশাসনের অধীনে আমেরিকা আবার পৃথিবীর নেতা হয়ে উঠবে। আমেরিকা যদি চীনের সঙ্গে বৈরিতাকে গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় রূপান্তর করে, তাহলে এমন আশাবাদ ঠিক আছে। কিন্তু বাইডেন আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে এবং তা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে তিনি কতটা কার্যকরভাবে তাঁর দেশের ভেতরের বিভেদগুলো দূর করতে পারবেন এবং আমেরিকান ভোটারদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিশ্বায়ন সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা আছে, তার নিরসন ঘটাতে পারবেন তার ওপর। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার বৈশ্বিক খ্যাতি ও মর্যাদার যে ভীষণ ক্ষতি করেছেন, জো বাইডেন তা ফিরিয়ে আনবেন বলে বারবার অঙ্গীকার করেছেন। সে জন্য তিনি দ্রুতই সেই সব বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ও আন্তর্জাতিক চুক্তিতে (যেমন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি) আমেরিকাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, যেগুলো থেকে ট্রাম্প আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।

এসব প্রতিশ্রুতি এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গির আভাস দিচ্ছে, যেখানে আমেরিকা একটি উদারপন্থী বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বের স্থানে ফিরে যাবে। সেটা হবে এমন এক অবস্থান, যেখান থেকে সে চীনের আরও কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারবে, আরও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবে। অবশ্য এমনটা ভাবারও যথেষ্ট কারণ আছে যে আমেরিকায় বহু মানুষ আছে, যারা চায় না তাদের দেশ আবার বিশ্বের নেতা হোক।

নভেম্বরের নির্বাচনে বাইডেনের বিজয় হয়েছে বটে, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প ও তাঁর বিষাক্ত জনতুষ্টিবাদকে ঝেঁটিয়ে তাড়ানো যায়নি। হ্যাঁ, বাইডেন ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন, আমেরিকার ইতিহাসে কোনো নির্বাচনে কোনো প্রার্থী এত ভোট পাননি। কিন্তু ট্রাম্পও কম ভোট পাননি; তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছেন ৭ কোটি ৪০ লাখ ভোট পেয়ে এবং ২০১৬ সালের তুলনায় এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের ভোটার বেড়েছে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে। একটার পর একটা অভূতপূর্ব কেলেঙ্কারি ঘটানো সত্ত্বেও কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় সাংঘাতিকভাবে ব্যর্থ হওয়ার পরও ট্রাম্প এত এত ভোট পেয়েছেন।

ট্রাম্পের এমন টেকসই জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যা কী? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে আমেরিকার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এখন অসুখী ও হতাশ। তাদের মধ্যে আছে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও নয়া নাৎসিপন্থীরা, যারা ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে তাণ্ডব চালিয়েছে। এমনকি যেসব মানুষ এই শ্রেণিতে পড়ে না, তারাও একজন প্রকাশ্য বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। তবু যদি বলা হয় ট্রাম্পের প্রতি এই সমর্থন গোঁড়া উগ্রপন্থার প্রতি সমর্থনের বেশি কিছু নয়, তাহলে সেটা খুব সরল ভাবনা হয়ে যাবে। স্মরণ করা দরকার, ২০১৬ সালে যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরই ১৩ শতাংশ ২০১২ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন বারাক ওবামাকে। ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে ২০১৬ সালের নির্বাচনের চেয়ে এক কোটি বেশি ভোট পেয়েছেন। ট্রাম্প যেমন বর্ণবাদী ও বিদেশবিদ্বেষীদের ভোট পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন গ্রামাঞ্চলের শ্রমজীবীদের ভোট, যাঁরা নিজেদের আয়-রোজগার বাড়ছে না বলে এবং ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে বলে ভীষণ অসন্তুষ্ট। এশীয় বংশোদ্ভূত ভোটারদেরও একটা অংশ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন চীনের ব্যাপারে তাঁর কঠোর অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানাতে।

অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্র যখন চীনের মতো উদীয়মান শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর দিকে সরে যাচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব দেশের অবস্থান ততই শক্তিশালী হচ্ছে। আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা মনে করেন, বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকেই প্রাধান্য পেতে হবে। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান দিয়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বনেতার প্রতিশ্রুতিগুলো থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন, বহির্বিশ্বে হস্তক্ষেপ কমিয়েছেন এবং একটা প্রাচীর নির্মাণ করেছেন। তাঁর ভোটাররা যা চেয়েছিলেন, তিনি ঠিক তা-ই দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নীতি থেকে অনিবার্যভাবে এমন পরিণতি সৃষ্টি হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা গ্রহণ করতে পারেননি। সেটা হলো চীনের ধারাবাহিক উত্থান; যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের পদক্ষেপ।

এখন বাইডেন প্রশাসনের সামনে থাকবে দুটো শিক্ষা। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে দুই নৌকায় পা দিতে পারবে না। সে বৈশ্বিক নেতৃত্ব ছেড়ে দেবে এবং সেই জায়গা আর কাউকেই নিতে দেবে না—এটা হবে না। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি গোঁয়ার্তুমি করে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিপদ দেখা দেবে।

দ্বিতীয়ত, চার বছর ধরে চীনের সঙ্গে বিরোধ করে আমেরিকা শুধু চীনের সঙ্গেই বিচ্ছেদ ঘটায়নি, বিশ্বায়নের সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। এর মানে, আমেরিকা যদি তার নেতৃত্বের অবস্থান ফিরে পেতে চায়, যে অবস্থানে সে চীনের সঙ্গে গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে এবং সেই নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে বাইডেন প্রশাসনকে বৈষম্য ও বিশ্বায়নের মাশুল মোকাবিলা করতে হবে।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইউয়েন ইউয়েন আং: যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক