আর কত রোহিঙ্গা দেশান্তরি হবে?

তিন লাখের অধিক রোহিঙ্গা দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে
তিন লাখের অধিক রোহিঙ্গা দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে

অং সান সু চি তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সব সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এ ‘নিশ্চিত নিরাপত্তাই’ কি গত তিন সপ্তাহে প্রায় তিন লাখের অধিক রোহিঙ্গার দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণ? এ নিরাপত্তাব্যবস্থাতেই কি সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নিহত আর তাদের অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? এগুলো সবই অপপ্রচার বললেন অং সান সু চি! এ কথাটা সবারই জানা যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে বসবাসকারী একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এই অঞ্চলকে এখন রাখাইন রাজ্য বলা হয়। উল্লেখ্য, রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী একটি সম্প্রদায়। তারা সেখানে রোহিঙ্গাদের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর বিরোধটা এ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্যই।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তমতে, রোহিঙ্গারাও সেই অঞ্চলে দীর্ঘকাল বসবাস করছে। এরা মুসলমান ধর্মাবলম্বী। সংখ্যা আগে যা-ই হোক, এখন প্রায় ১১ লাখে নেমে এসেছে। জানা যায়, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে চলে গেছে যথাক্রমে ৪ ও ২ লাখ। তবে বাংলাদেশ নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় প্রথম ও মূল চাপটা পড়ে আমাদের ওপর। জাতিগত নিধনের এক নির্মম শিকার এ জনগোষ্ঠী। গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল এরা। পাশাপাশি এ সমস্যায় ভারাক্রান্ত বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও পরিস্থিতি ইতিবাচক মোড় নেওয়ার প্রত্যাশায় ছিল। কিন্তু বিধি বাম, রোহিঙ্গাদের তিমির আরও ঘনীভূত হয়েছে। আর এমনটা ঘটছে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রবল আপত্তির মুখেই।

বিষয়টি আরও বেদনাদায়ক এ কারণে যে দেশটির নেতৃত্বে এখন রয়েছেন দীর্ঘকাল কারা যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা অং সান সু চি। তিনি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও লাভ করেছেন। অবশ্য আমরা জানি রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁর দলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব নেই। সামরিক বাহিনী রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। তা সত্ত্বেও সু চির দল সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে জাতিসংঘের সাবেক স্বনামধন্য মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠন করে। রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা অবসানের জন্য কার্যক্রম সুপারিশ করা এ কমিশনের মূল কার্যপরিধি।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা গেল, কমিশন গঠনের সংবাদ এবং এর প্রতিবেদন দেওয়ার পরপর দুই দফায় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু হয়ে যায়। আর এটা পরিচালনায় রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। অবশ্য দুবারে একই ধরনের কারণ সামনে আসে। রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী পুলিশ ও সেনাশিবিরে হামলা ও হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হতাহত রোহিঙ্গারাই অনেক বেশি। তবে হামলাকারীদের সে দেশের আইনের আওতায় আনতে কেউ আপত্তি করছে না। তবে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকদের তল্লাশি চালানোর নামে রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতন চলা বেদনাদায়ক। এক বছর আগেও এমনটা হয়েছিল। মূলত কোনো না কোনো কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকেই সে অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি চলছে। প্রাণভয়ে কিংবা নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে রোহিঙ্গারা ছুটছে নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের দিকে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ নিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকলেও শেষ দিকে মানবিক কারণে শিথিল করা হয়। ঢুকে পড়ে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের অনেকেই অনিবন্ধিত হিসেবে আছে টেকনাফ উপত্যকায়। এ ছাড়া ১৯৯২ সালে আসা অবশিষ্ট প্রায় ৩০ হাজার নিয়ে চলছে শরণার্থী শিবির। তদুপরি সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশে গেছে কত রোহিঙ্গা, তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। আমাদের এই জনবহুল ছোট দেশটিতে ধারণ করতে হচ্ছে তাদের। অন্য দেশ সাহায্য-সহযোগিতা দিলেও সেসব জনবিরল দেশে পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করে না। অথচ ভুটান থেকে ফেরত যাওয়া প্রায় ১ লাখ নেপালি শরণার্থী সেই সুযোগ পেয়েছে। তবে প্রশ্ন থাকবে, রোহিঙ্গাদের নিজের দেশ বারবার ছাড়তে হবে কেন? শখ করে কেউ তা করে না, এটা জোর দিয়ে বলা যায়। উর্বর জমি, প্রচুর বনজ সম্পদ সমৃদ্ধ এ অঞ্চল ছেড়ে তাদের দলে দলে অন্যত্র শরণার্থী হওয়ার কথা নয়। তবে তা হচ্ছে প্রাণ ও মানের ভয়ে। ক্ষেত্রবিশেষে জীবন-জীবিকার পথকে অমানবিকভাবে অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য।

কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে পৃথিবীর বৃহত্তম এই রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমারকে সতর্ক করা হয়েছে। কমিশনের মতে, মিয়ানমার তাদের সার্বভৌমত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অধিকার রাখে। তবে শক্তি প্রয়োগের বদলে সমঝোতাই এখানে অধিকতর সুফল দেবে বলে কমিশন বিবেচনা করে। প্রাথমিক ধাপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের অতি অবশ্যই নাগরিকত্ব দিতে এবং চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন এটাও উল্লেখ করেছে যে বর্তমান পরিস্থিতিতে চরমপন্থী কোনো গোষ্ঠী অতিসহজেই ক্ষুব্ধ ও হতাশ রোহিঙ্গাদের কিছু লোককে দলভুক্ত করে ফেলতে পারে। সে পথ সংকীর্ণ করতে সমঝোতার মাধ্যমে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরও সহায়তা পেতে পারে।

এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, দেশটি ১৯৮২ সালের আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বই স্বীকার করে না। তাদের চলাচলে আরোপ করা হয় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সীমাহীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হয় এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। শিক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও ত্রাণকর্মীদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। এর প্রেক্ষাপটে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের মূল দুটি সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। চলাচলের অধিকার প্রশ্নটি কার্যত স্বৈরশাসনের ধারাবাহিকতা। এটা সব সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল। এক টাউনশিপ (আমাদের থানার ন্যায় প্রশাসনিক অঞ্চল) থেকে অন্যত্র গিয়ে রাতযাপন করলেও পুলিশকে জানাতে হতো। এ ব্যবস্থা কিছুদিন আগে তুলে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনীর মাঝে এর সুফল ভোগ করতে পারছে না। জীবিকার সন্ধানেও অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ তাদের খুবই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এ নিয়ন্ত্রণ তুলে দিলে জীবনযাত্রার মানও বেড়ে যাবে।

তবে এই কমিশনের সুপারিশ কবে, কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সে সম্পর্কে সংশয়বাদী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বহু জাতি-গোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমারে জাতিগত বিভেদ তুঙ্গে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারগণ (বার্মিজ) সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চায়। আর এরূপ চাইলেই সংঘাত হয়ে পড়ে অনিবার্য। তেমনটাই ঘটছে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। ভিনদেশে আশ্রয় নিতে হয় বারবার। আর অপারগ হলেও আমরা তাদের ফেলে দিতে পারি না চরম বিপর্যয়ের মুখে। ফলে আমাদের জনজীবনে মিশে যাচ্ছে মিয়ানমার থেকে আসা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা। এটা আমাদের অর্থনীতির ওপরও অতিরিক্ত চাপ। বিরূপ প্রভাব ফেলছে স্থানীয় শ্রমবাজারে। পর্যটনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল টেকনাফ উপত্যকায় তাদের উপস্থিতি কিছুটা বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের বনজ সম্পদে। অপরাধ জগতে তাদের খুব কম পারিশ্রমিকে নিয়োগ করতে পারে গডফাদাররা। এগুলো সবই সত্য। কিন্তু ফেলারও উপায় কোথায়?

এখানে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের সহায়তা মেলে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। এখানে মানবেতর শিবিরে জীবন কাটাচ্ছে ১৯৯২ সালে আসা কিছু শরণার্থীও। তখন যারা জন্ম নিয়েছিল, তাদের অনেকে এখন শিশুর পিতা-মাতা। সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান মিয়ানমারের হাতে। তবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমশক্তি আমদানিনির্ভর দেশগুলো এখানে কিছু অতিরিক্ত ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের প্রাচুর্য রয়েছে। রয়েছে বিশাল ভূখণ্ড। তারা নিবন্ধিত এবং শিবিরে বসবাসকারী অনিবন্ধিত বেশ কিছু শরণার্থীকে সেসব দেশে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এটা মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের চলে আসার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। তাই পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারকে নিজেদের গঠিত কমিশনের প্রতিবেদন দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক জোরদার প্রচেষ্টা আবশ্যক। এ বিষয়ে চীন বরাবর মিয়ারমারকে সমর্থন করে। এবার ভারতের ভূমিকাও অনেকটা তা-ই। এ দুটি দেশের কাছে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সমস্যাটির আইনগত ও মানবিক দিক জোরালোভাবে তুলে ধরা দরকার। চুপ করে বসে থাকলে ঘাড়ের বোঝা বাড়তেই থাকবে। কারও প্ররোচনায় আমরা সংঘাতেও যেতে পারি না। কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে নিজ দেশেই মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে রোহিঙ্গারা। তখন দলে দলে পরবাসী হবে না। বরং যারা এসেছে, তারা চাইবে ফিরে যেতে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।