আরও কঠিন আইন চাই

এই সরকারের সাফল্যের কোনো তুলনা নেই। তারা উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, দেশকে অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচিয়েছে। তারা নেতা, চেতনা, ভাবমূর্তি ও ইতিহাসকে রক্ষা করেছে। এসব করার জন্য নিন্দিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও নতুন নতুন আইন করেছে, নতুন নতুনভাবে তার প্রয়োগ করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে এরপরও ষড়যন্ত্র আর বিদ্বেষ থেমে নেই দেশে-বিদেশে!

ষড়যন্ত্র রোধে দেশে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ), আছে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি ও নিবর্তনমূলক আটকের বিশেষ বিশেষ আইন। এসব আইনে এক অভিযোগে এক শ মামলা করার মতো কর্মী বাহিনী আছে, এসব মামলা নেওয়ার মতো উদার বিচার বিভাগ আছে। মামলায় না কুলালে পেটানোর জন্য পুলিশ আছে, হাতুড়ি আর হেলমেট বাহিনী আছে, আছে উল্টো মামলা দেওয়ার ফৌজদারি আইন।

এই আইনগুলোর মধ্যে নতুনগুলো করা হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে। কিন্তু ২০১৬ সালের ডিএসএ আইনের বলে মামলা দেওয়া হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার, দুর্বৃত্তদের জেলে আটক রাখা গেছে মাত্র কয়েক মাস, রাষ্ট্রের হেফাজতে প্রাণ ত্যাগ করেছেন গুটিকয় লোক। ২০১৬ সালের আরেকটি নতুন আইন (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে বৈদেশিক অনুদান-সংক্রান্ত) মুখ বন্ধ করা গেছে সামান্য কিছু মানবাধিকার সংগঠনের। ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচার বন্ধে এসব আইন তাই যথেষ্ট হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে এবং এরপর সরকারের কার্যক্রম নিয়ে দুর্মুখদের সমালোচনা বন্ধ করা যায়নি।

সামনে আছে নতুন নির্বাচন। এটা নিয়ে ষড়যন্ত্র আরও পাকিয়ে উঠছে। এরা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, ওরা ভিসা বাতিল করছে, তারা আরও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিচ্ছে। দেশের সুচতুর সুশীল সমাজ এই সুযোগে মন্ত্রী হওয়ার ধান্দা করছে। বাম-ডান মিলে অনির্বাচিত সরকার চাচ্ছে নির্বাচনের সময়। বিদেশ থেকে বিপথগামীরা সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই প্রচারণায় নেমেছে।

সরকারকে তাই বাধ্য হয়ে আরও কিছু নতুন আইন করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব নতুন আইনই কি যথেষ্ট হবে ষড়যন্ত্র ঠেকাতে? নাকি আরও কিছু নতুন আইনের কথা ভেবে দেখবে সরকার?

এ দেশে ভুয়া নির্বাচন, রাষ্ট্রের সম্পদ লুট, দুর্নীতি, গুম-ক্রসফায়ার-নির্যাতন এসব সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে, এসব কথা বলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা, উন্নয়নের গতিপথকে রুদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের ‘পক্ষ’ শক্তিকে হেয় করা। কাজেই এসব বন্ধ করার জন্য নতুন নতুন আইনের দরকার আছে অবশ্যই!

২.

দুর্মুখেরা বলে থাকে যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থী ছিল না, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটারই ছিল না। তাদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারই থাকবে না, নির্বাচন হবে কাগুজে প্রমাণবিহীন মেশিনে (ইভিএম)। মানুষ না, ভোটের ফলাফল ঠিক হবে মেশিনের পেছনের ব্যক্তিদের ইচ্ছায়। এসব দুর্মুখের সঙ্গে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তির আঁতাত।

দোষ তাদেরই। তাদের ঠেকাতে এবারও নির্বাচনের আগে সরকারকে তাই একগাদা নতুন আইনের চিন্তা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্ম রেগুলেশন, ওটিটি কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা পরিচালনা নীতিমালা। মাসখানেক আগে এক পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘আজ আমার মন খারাপ’ এটি লিখলেও নাকি এসব আইনে মামলা হতে পারে। ফেসবুকে ঠিক এ লাইনটি লিখেই এরপর বহু মানুষ এসব আইন নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করেছেন। এতে আইনের শাসনের ভাবমূর্তি বিপন্ন হয়েছে।

এ ধরনের লোকজনকে ঠেকানোর জন্য হলেও তাই নতুন আইনের প্রয়োজন আছে। এসব আইন হলে সরকার ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল ধরনের যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, ষড়যন্ত্রকারীদের তথ্য বিনিময়ের ওপর নজরদারি করতে পারবে, আগামী নির্বাচনকে ভুয়া বা নিশি নির্বাচন বলার মতো দেশদ্রোহী কাজ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

এসব আইনে আরও উপকার হবে। এসব দিয়ে গুম-খুন-নির্যাতনের ঘটনায় দেশপ্রেমী বাহিনীকে দায়ী করে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা রোধ করা যাবে, বিদেশি বিভিন্ন ষড়যন্ত্র থেকে নাগরিককে নিবৃত্ত রাখা যাবে, তাদের চিন্তাকে চেতনামুখী করা যাবে।

এমন চমৎকার চমৎকার আইন তো হতেই পারে এ দেশে!

৩.

তবে এসব আইনও হয়তো সরকারের জন্য যথেষ্ট হবে না। এসব আইন ঠেকাবে ‘অনলাইন’জগতের দুর্বৃত্তদের। কিন্তু মাঠে-ময়দানে, পথে-প্রান্তরে দুর্বৃত্তদের দমন এবং বিভিন্ন ধরনের ‘অফলাইন’ অপতৎপরতা ঠেকানোর জন্য আরও নতুন আইনের কথা সরকারের ভাবা প্রয়োজন। এ ধরনের কিছু আইনের প্রস্তাব করছি এখানে।

ক) বিরোধী দলের দায় নির্ধারণ আইন: এই আইনে বিরোধী দল বলতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ দলগুলোকে বোঝাবে। যেকোনো ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গোলযোগের জন্য তারা দায়ী, এটি ধরে নিয়ে গ্রেপ্তার ও তদন্ত শুরু হবে। উপকারিতা: এই আইন কার্যকর হলে নিউমার্কেট-ঢাকা কলেজ থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো যেকোনো ঘটনায় বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গী নেতাদের আইনি মোড়কে গ্রেপ্তার করা যাবে। এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়ে তাঁদের দমন করাও সহজ হবে।

আরও পড়ুন

খ) শিবির পেটানো বৈধকরণ আইন: এই আইনে যে কাউকে শিবির আখ্যায়িত করে পিটিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা যাবে। এসব কাজে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও প্রভোস্টদের সহায়তা করার আইনগত বৈধতা দেওয়া হবে। উপকারিতা: এই আইনবলে বিশেষ করে দেশের তরুণ সমাজকে আতঙ্কিত রাখা যাবে এবং চেতনার পক্ষের শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।

গ) বিদেশি এজেন্ট আইন: এই আইনবলে বিদেশি অনুদানে পরিচালিত সরকার সমালোচক দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও গবেষককে সরকার প্রয়োজন মনে করলে বিদেশি এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারবে এবং তার উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করতে পারবে। উপকারিতা: এই আইন করা হলে ভবিষ্যতে নির্বাচন, মানবাধিকার, দুর্নীতি বা গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরোধ করা যাবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বিপুলভাবে রক্ষা করা যাবে।

ঘ) আত্মীয়স্বজনের দায় নির্ধারণ আইন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারকারী দুর্বৃত্তদের ঠেকানোর জন্য এই আইনে তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকেও গ্রেপ্তারের বিধান করা যেতে পারে। উপকারিতা: এটি করা হলে বিশেষ করে বিদেশ থেকে অপপ্রচারকারীদের মনে পারিবারিক দুর্ভোগের আশঙ্কা তৈরি করে তাদের দমানো যেতে পারে। আইনটি করা হলে দুর্বৃত্তদের পিতা-মাতা বা ভাই-বোনদের (বাংলাদেশে অবস্থানরত) বিরুদ্ধে ডিএসএর অধীনে বিতর্কিত মামলা দেওয়ার ঝুঁকিও আর থাকবে না।

আরও পড়ুন

ঙ) বাহিনী লীগ দায়মুক্তি আইন: এই আইনের আওতায় সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের চাকরিতে বিশেষ সুবিধা ও দায়মুক্তি দিয়ে ষড়যন্ত্র রোধে তাদের প্রণোদনা প্রদানকে আইনসম্মত করা যাবে। উপকারিতা: এই আইন হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অযথা সমালোচনা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো দুটো উন্নয়নমুখী নির্বাচন দেশকে উপহার দিতে পারবে, এবং মধ্যম আয়ের দেশে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করতে পারবে।

এসব ছাড়াও বিনা ভাড়ায় সরকারি দলের আত্মীয়স্বজন ভ্রমণ আইন, উল্টো পথে তাঁদের অবাধ চলাচল আইন, অবাধে বিদেশ সফর আইন, প্রকল্পের ব্যয়-সংক্রান্ত দায়মুক্তি আইন ধরনের আরও কিছু আইনও করা যেতে পারে।

৪.

ওপরে প্রস্তাবিত আইনগুলোর প্রয়োজন আছে দেশে। আইন ছাড়া উল্লিখিত কাজগুলো করতে গিয়ে আইনের শাসন নেই বলে সরকারের সমালোচনা হয়েছে। আইন করে এসব করলে এসব সমালোচনা বন্ধ হবে। দেশে আইনের শাসন পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এ দেশে ভুয়া নির্বাচন, রাষ্ট্রের সম্পদ লুট, দুর্নীতি, গুম-ক্রসফায়ার-নির্যাতন এসব সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে, এসব কথা বলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা, উন্নয়নের গতিপথকে রুদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের ‘পক্ষ’ শক্তিকে হেয় করা। কাজেই এসব বন্ধ করার জন্য নতুন নতুন আইনের দরকার আছে অবশ্যই!

আর কিছু না হোক, ‘আইন’ আর ‘শাসনের’ জয় হোক দেশে!

  • আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক