আরব শাসকেরা নিন্দা করেননি

আপনি হয়তো মনে করবেন, ট্রাম্প প্রশাসন কট্টর ও কর্কশভাবে মুসলিমবিরোধী হওয়ায় আরব রাজা ও একনায়কেরা লাইন ধরে এই মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিন্দা করবেন। যে প্রেসিডেন্ট আবার নির্যাতন অনুমোদন করেন। তিনি ‘মন্দ লোক’ ও ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ নিয়ে অনেক অর্থহীন কথা বলেছেন। ব্যাপারটা ভয়ংকর। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা সে রকম কিছু নয়। আরবের একনায়কেরা ফোন করতে করতে হোয়াইট হাউসের সুইচবোর্ড ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন। এর মধ্যে যেমন মিসরের সিসি আছেন, তেমনি উপসাগরের আরবেরাও আছেন। জর্ডানের বাদশাহ–ই প্রথম ট্রাম্পের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, এরপর তাঁর পথ অনুসরণ করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

ব্যাপারটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ। ইউরোপীয়রা হয় গা মোচড়ামুচড়ি করে, না হয় ছি ছি করে। এমনকি কখনো কখনো তারা মৃদুস্বরে নতুন মার্কিন সরকারের সমালোচনা করে। ট্রাম্প জামানার যারা প্রধান ভুক্তভোগী, তারা হয় চাটুকারিতা করার জন্য নিশ্চুপ থাকে, নাহয় ট্রাম্পের মুসলমানবিরোধী প্রচারণায় অনুমোদন দেয়। সম্ভবত ফিলিস্তিনের বেচারা মাহমুদ আব্বাস ভাগ্যবান যে তিনি তিনবার ফোন করলেও ট্রাম্প একবারও প্রত্যুত্তর করেননি। তবে সবার ধারণামতো আইএস ট্রাম্পের নিন্দাবাদ করেছে। আল-কায়েদাও তা-ই করেছে। তারা বলেছে, হোয়াইট হাউসে একজন ‘বেকুব’ বাস করছেন। আধুনিক ইতিহাসে এটাই প্রথম ঘটনা, ৯/১১-এ যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের মনোভাব আর মার্কিন জনগণের অর্ধেকের মনোভাব মিলে গেল। আলজেরীয়রাও ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তার কিছুদিন আগে তারা পূর্ব আলেপ্পোতে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিজয়’ লাভের জন্য বাশার আল-আসাদকে অভিনন্দন জানিয়েছিল।

নিশ্চিতভাবে আইএস এই ভেবে সংকীর্ণ   তৃপ্তি পেতে পারে যে ট্রাম্প সত্যিই একজন মুসলিমবিরোধী। আর দুর্নীতিগ্রস্ত আরব একনায়কেরা সবচেয়ে অমনোযোগী মানুষ। কিন্তু নতুন মার্কিন জামানার প্রতি আরব সরকারগুলো যেভাবে সাড়া দিয়েছে, এটা বোঝাতে যে তারা ঠিক কতটা ঘনিষ্ঠ। আরবের অধিকাংশ একনায়ক বহু বছর ধরে মানুষকে ‘ভুয়া খবর’ ও ‘বিকল্প তথ্য’ দিচ্ছেন। তাঁরা সব সময় ‘ইহুদিবাদী সত্তার’ বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের অঙ্গীকার করছিলেন। আবার একই সঙ্গে তাঁরা মিত্রদের বিরুদ্ধে রোষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সৌদিরা বারবার ইরাক ও সিরিয়ায় হামলা করেছে। আমিরাত ও মিসর লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ করেছে। আবার সৌদি ও আমিরাত ইয়েমেনে হামলা করেছে। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত যে আরব ও ট্রাম্প উভয়েই ক্লিশে ব্যবহার করে।

এটা যদি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘মন্দ লোক বা ইসলামি ফ্যাসিজম’ মন্ত্র না হয়, তাহলে এটা হবে এ রকম: ‘ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শুধু আমরাই দাঁড়িয়েছি।’ মধ্যপ্রাচ্যের একনায়ক ও মারদাঙ্গা সরকারগুলো বহু বছর ধরে এই আবর্জনা দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি, সাদাত, মোবারক, সিসি, আসাদ, সাদ্দামের মতো মানুষেরা নিজের জনগণকে অলীক কল্পনার মধ্যে রাখছেন, কিন্তু যারা তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন, তাঁদের হুমকি দিচ্ছেন।

বটেই, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের সরকারপন্থী ও ভিতু গণমাধ্যম ট্রাম্প যে ‘অভিযোগ সাংবাদিকতায়’ বিশ্বাস করেন, তারা অনেকটা সে রকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মিসর ও সিরিয়ার সরকারি টেলিভিশন দেখতে চান, তাহলে ফক্স নিউজ দেখুন। আরবের নিরাপত্তা পুলিশের যে ক্ষমতা, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঈর্ষার কারণ। তারা নিজেদের পুলিশকেও একই ক্ষমতা দিতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যে সংখ্যালঘুরা নিপীড়িত হয়েছে। বিচারকদের চোখ রাঙানো হয়েছে। রাজনীতিকদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, এখানকার শাসকেরা নির্যাতনে বিশ্বাস করেন। কারও কথা মনে করিয়ে দিতে হবে? তাহলে ট্রাম্পের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত!

মনে আছে, মোবারক সব সময় ভুয়া নির্বাচন দিতেন, যেটা ট্রাম্প নিজেও পছন্দ করেন। এরপর নির্বাচনে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তিনি রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয়ের কাছ থেকেই অভিনন্দন পেতেন। ট্রাম্পের অনেক পুরোনো সচিব শন স্পাইসার ও তাঁর ভাগ্যহীন সহযোগীদের অনুরূপ ব্যক্তিদের আরব দেশগুলোর তথ্য মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়, তাঁরা যেন সত্যের প্রতিমূর্তি, যাঁদের কাজ হচ্ছে অলীক কল্পনা ও মনিবদের ছোটখাটো রাগের পুনরাবৃত্তি করা। তুলনা পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে, কারণ আরবের তথ্য মন্ত্রণালয়গুলোর হাতে তথ্যই থাকে না।

আমাকে বলতে হবে, যেহেতু ট্রাম্প ও ট্রাম্প-দুনিয়া প্রায় একই জিনিস, তাই এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে একটি আরেকটি থেকে পরিষ্কারভাবে বিচ্যুত হয়েছে। আরবেরা ইসরায়েলবিরোধী, তাই প্রায়ই তাদের সেমিটীয়বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু আরবেরাও সেমিটীয়। আর ট্রাম্প যেহেতু হলোকাস্ট মেমোরিয়াল ডেতে ইহুদিদের কথা উচ্চারণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং দৃশ্যত ছয়টি আরব দেশের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা রয়েছে, তাই তাঁকে সেমিটীয়বিরোধী বলা যেতে পারে, আরব ও ইহুদিবিরোধী নয়। কিন্তু আসুন, আমরা হক কথা বলি। যেসব আরব দেশের একনায়কেরা এখন যুদ্ধে নেই, ট্রাম্প যদি সেই দেশগুলো সফর করেন, তাহলে তিনি অনেকটা স্বস্তি বোধ করবেন: যারপরনাই বিশাল নিরাপত্তা ও দারুণ পুলিশি ব্যবস্থা, হরেদরে নির্যাতন, অত্যন্ত ছলনাময় নির্বাচন ও বড় বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প—যার কারণে পরিবেশদূষণ হচ্ছে, কিন্তু যেগুলো একেবারেই অকার্যকর। আর তিনি যদি ছেলে এরিক ও ডোনাল্ড জুনিয়রের সঙ্গে যোগ দিয়ে দুবাইয়ে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল গলফ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলে ট্রাম্প প্রকৃত অর্থে ট্রাম্প-দুনিয়াতেই থাকবেন।

আরবের শাসক, রাজা ও দুষ্ট একনায়কদের সত্যিই আগামী মাসে ওয়াশিংটনের সম্মেলনে যোগ দেওয়া উচিত। তাঁরা দেখবেন, সেখানকার পরিবেশ ঠিক তাঁদের মতোই। আর প্রেসিডেন্টের কথা নাইবা বললাম।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকেনেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি