আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাত কদ্দূর গড়াবে

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতে এখন পর্যন্ত এক শ লোক নিহত ও কয়েক শ লোক আহত হয়েছেছবি: রয়টার্স

গেল রোববার আর্মেনিয়া সরকার নাটকীয়ভাবে দেশটিতে সামরিক আইন জারি করেছে। একই সঙ্গে তারা তাদের সেনাবাহিনীকে সুসংহত করার কাজ করছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিজ নিজ নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

আর্মেনিয়ার সরকার বলেছে, নাগোরনো-কারাবাখ নামের যে এলাকাটিকে তারা নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে থাকে, সেই এলাকায় প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজান সামরিক অভিযান চালিয়েছে। অবশ্য আজারবাইজান বলেছে, আর্মেনীয় সেনাদের গোলা হামলার পাল্টা জবাব দিতেই তারা নাগোরনো-কারাবাখ এলাকায় হামলা চালিয়েছে।

নাগোরনো-কারাবাখ এলাকাটি মুসলিমপ্রধান দেশ আজারবাইনের ভূখণ্ড বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ওই এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা যেহেতু আর্মেনীয় খ্রিষ্টান, সেহেতু তারা আজারবাইজানের শাসনাধীন থাকতে চায় না। প্রায় এক শতাব্দী ধরে নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা আজারবাইজানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে। ১৯৯১ সালে ভূখণ্ডটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল এবং তখন থেকে তারা আর্মেনীয় সরকারের মদদ নিয়ে স্বশাসন বজায় রেখে আসছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও রিপাবলিক অব আর্তাসক নামের একটি সরকার ভূখণ্ডটি শাসন করে থাকে।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের দ্বন্দ্ব অবসানে যে শান্তিপ্রক্রিয়া চলে আসছে, তা গত দুই বছরে দৃশ্যত বেশ খানিক এগিয়েছিল। তার মধ্যেই ইউরোপের অন্যতম ‘হিমঘরে থাকা সংঘাতের’ আবার উদ্‌গিরণ ঘটেছে।

রোববার থেকেই নাগোরনো-কারাবাখের সেনারা আর্মেনিয়ার সেনাদের সঙ্গে এক হয়ে আজারবাইজানি স্থল ও বিমানবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে।

রোববার থেকে এ পর্যন্ত সেখানে কমপক্ষে এক শ লোক নিহত ও কয়েক শ লোক আহত হয়েছে। আজারবাইজান নাগোরনো-কারাবাখের বড় একটি এলাকা দখল করে নিয়েছে বলে দাবি করলেও আর্মেনিয়া তা অস্বীকার করেছে। সব মিলিয়ে সেখানে এখন সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে।

নাগোরনো-কারাবাখের পুরো অঞ্চলই আজারবাইজানের সীমানার ভেতরে পড়েছে। পার্বত্য এই এলাকার চার দিকই স্থলসীমানা দ্বারা বেষ্টিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন সৃষ্টির আগে থেকেই এটি স্বাধীন হবে, নাকি আজারবাইজানের সঙ্গে অখণ্ড এলাকা হিসেবে থাকবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয় দেশই যখন সোভিয়েত রাষ্ট্র হিসেবে ছিল, তখন এ–সংক্রান্ত সব ধরনের উত্তেজনা দমন করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শীতল যুদ্ধ এবং এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ অবসানে চেপে রাখা উত্তেজনার উদ্‌গিরণ হয়।

আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ সময় আর্মেনীয় বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখসহ আজারবাইজানের আরও কয়েকটি এলাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ১৯৯৪ সালে অস্ত্রবিরতি চুক্তির মাধ্যমে সেই যুদ্ধের অবসান হয়।

নাগোরনো-কারাবাখ এলাকাটি মুসলিমপ্রধান দেশ আজারবাইনের ভূখণ্ড বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু ওই এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা যেহেতু আর্মেনীয় খ্রিষ্টান, সেহেতু তারা আজারবাইজানের শাসনাধীন থাকতে চায় না। প্রায় এক শতাব্দী ধরে নাগোরনো-কারাবাখের আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা আজারবাইজানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে। ১৯৯১ সালে ভূখণ্ডটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল এবং তখন থেকে তারা আর্মেনীয় সরকারের মদদ নিয়ে স্বশাসন বজায় রেখে আসছে

রিকনসিলিয়েশন রিসোর্সেস নামের একটি শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক গ্রুপের ককেশাস প্রোগ্রাম ডিরেক্টর লরেন্স ব্রোয়ার্স বলেছেন, এ দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকভাবে সজ্জিত সীমান্ত হিসেবে ধরা হয়। তিনি বলেছেন, উভয় দেশের সীমানায় পরিখা খনন করে সেখানে সার্বক্ষণিক সেনা মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। পরিখাগুলো এত কাছাকাছি যে এক পরিখায় বসে কোনো সেনা অন্য পরিখার সেনাদের সঙ্গে কথোপকথন করতে পারেন।

আজারবাইজান মুসলিমপ্রধান এবং আর্মেনিয়া খ্রিষ্টান প্রধান দেশ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের পেছনে ধর্মীয় কারণ বেশি কাজ করে বলে মনে করা হয়। তবে অনেকে এটিকে অতিরঞ্জিত মত বলেও মনে করে। কারণ, আজারবাইজান বহু আগে থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে জোরালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে চলেছে।

এখন প্রশ্ন হলো এ উত্তেজনা এখন কেন চাঙা হলো? কেনই–বা আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধ বেঁধে গেল?

আসলে ২০১৮ সালে একটি আন্দোলনের পর আর্মেনীয় নতুন প্রজন্মের মধ্যে আশা জেগেছিল অচিরেই নাগোরনো-কারাবাখের বিষয়ে সুরাহা হবে। কিন্তু এ আশাবাদের মধ্যেই আজারবাইজানের নেতারা অভিযোগ করেন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। আজারবাইজান অভিযোগ করেছে, আর্মেনিয়া নতুন করে আজারবাইজানের ভূমি দখলের পাঁয়তারা করছে।

আজারবাইজানকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তুরস্ক। রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে আর্মেনিয়ার পাশে থাকলেও আজারবাইজানের অভিজাত গোষ্ঠীর সঙ্গে রাশিয়ার সদ্ভাব রয়েছে। আর্মেনিয়ার অভিযোগ আজারবাইজানের তেল ও গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে তুরস্ক তাদের মদদ দিচ্ছে। তুরস্ক সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরও ভাড়া করে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করাচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেছে।

তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কত দূর গড়াবে, তা বুঝতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মিখাইল সাফি: দ্য গার্ডিয়ানের আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা