আলতাফ হোসেন

শহীদ বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, সিলেট , মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

আলতাফ হোসেন

কর্মজীবনে সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন আলতাফ হোসেন। নিজে ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ, তেমনি অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকেও কর্তব্যপরায়ণতা আশা করতেন।

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। একটা শিল্পীমন ছিল তাঁর মধ্যে। নিজ হাতে ফুলের বাগান করতেন।

বিশেষভাবে অনুরাগী ছিলেন গোলাপ ফুলের প্রতি। বাচ্চাদের লেখাপড়ার যত্ন নিতেন, রাতে ঘুমানোর আগে গল্প বা উপন্যাস এবং সকালে নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন।


সরকারি চাকরি করলেও রাজনৈতিক ঘটনাবলির দিকে লক্ষ রাখতেন। ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা এবং বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করতেন।


আলতাফ হোসেন চাকরি করতেন ওয়াপদার পানি উন্নয়ন বিভাগে (স্বাধীনতার পর ওয়াপদা বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নামে আলাদা দুটি সংস্থা গঠন করা হয়)।

একাত্তরে সিলেট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পরোক্ষভাবে নানা সাহায্য-সহযোগিতা করেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো সিলেটেও শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। এ সময় আরও অনেকের মতো তিনিও পরিবারসহ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

কয়েক দিনের মধ্যেই সিলেট শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ৫ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল তাঁর সরকারি বাড়িতে প্রবেশ করে।

তখন দুপুরের খাবারের সময়। সেনারা সদর দরজায় সমানে বুটের লাথি দিতে থাকলে আলতাফ হোসেন নিজেই দরজা খুলে দেন।

খোলার সঙ্গে সঙ্গে এক সেনা তাঁর বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘শালা, শুয়োর কি বাচ্চা, বলো, তুমলোগ হিন্দু না মুসলমান।’


হতভম্ব আলতাফ হোসেন জবাব দেওয়ার আগেই সেনারা বাসার সবাইকে টানতে টানতে বাসার বাইরে একটি টিলার কাছে এনে দাঁড় করায়।

সেখানে সবাইকে ‘হ্যান্ডস আপ’ বললে আলতাফ হোসেন বলেছিলেন, ‘কেন আমাদের মারবে? আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা।

আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।’ তাঁর মুখের কথাও শেষ হয় না, ঘাতকদের গুলি তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দেয়।


এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগমের ‘আমার স্বামী’ রচনা থেকে। সংক্ষিপ্ত এই রচনায় তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল তিনি কয়েকজন হানাদার বাহিনীর শিকারে পরিণত হন।

পর পর তিনটি গুলি তাঁর বুকে বিদ্ধ করে তাঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। নরপিশাচ পাক সৈন্যরা।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৮৯)।

আলতাফ হোসেনের জন্ম ১৯২৩ সালের ১ মার্চ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দিতে। বাবা ওয়াহিদুর রহমান, মা মিছানুতননেসা খাতুন।

মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ম্যাট্রিক ও আইএসসি প্রথম বিভাগে এবং ১৯৪৭ সালে বহরমপুর কলেজ থেকে ডিসটিংশনসহ বিএসসি পাস করেন।

ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।

১৯৫১ সালে বিএসসি (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) পাস করেন। এই বছরই সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান ইরিগেশন বিভাগে।


১৯৫৩ সালে ইরিগেশন বিভাগের কর্ণফুলী প্রজেক্টে যোগ দেন। ১৯৫৯ সালে ওয়াপদার উপপরিচালক নিযুক্ত হন।

এই সময় উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় যান। তখন বন্যানিয়ন্ত্রণ সম্পর্কেও তিনি অর্জন করেছিলেন বিশেষ জ্ঞান।

পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়াপদার বন্যানিয়ন্ত্রণ উইংয়ের পরিচালক পদে উন্নীত হন। একাত্তরে সিলেট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন।


আলতাফ হোসেন তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ছেলে আরিফ হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও আখতার হোসেন। মেয়ে নায়ার সুলতানা ও সেলিনা সুলতানা।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (সপ্তম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৮) থেকে।


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
[email protected]