আলিয়া শিখিয়ে দিলেন দেশপ্রেম কী

স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা স্মারক হাতে আলিয়া বেগম

আলিয়া বেগমের কাছ থেকে আমরা কত–কী যে শিখলাম।

২২ ডিসেম্বর ২০২০। ঢাকার সোবহানবাগে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ‌্যালয়ের হলরুমে আমরা বসে আছি মাস্ক পরে, যতটা পারা যায়, দূরত্ব বজায় রেখে। দর্শক আসনে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সরকারি অধিদপ্তরের পরিচালক—বিশিষ্ট সুধীজনেরা। আয়োজনটার নাম ভিএস প্রথম আলো স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা। সারা দেশ থেকে বাছাই করা স্বেচ্ছাসেবী মানুষ ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।

রাজশাহীর মুন্সিপাড়া থেকে এসেছেন একজন। আলিয়া বেগম (৩৫)। লেখাপড়া তিনি কিছু করেছিলেন কি না, আমার জানা নেই। ১৩ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তিন বছরের মাথায় স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। তাঁদের মেয়ে টুম্পার বয়স তখন দেড়। আলিয়া অগাধ সলিলে পড়লেন। বই বাঁধাইয়ের কাজ আরম্ভ করেন। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নেন।

হাসপাতালে তিনি দেখেন, এমন রোগী আসে, যাঁরা কথা বলতে পারে না, হয়তো অচেতন, তাঁরা হয়ে পড়েন অজ্ঞাতনামা। তাঁদের দেখার কেউ নেই। অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁদের কেউ দেখে না, সুস্থ হলেও তাঁদের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। আলিয়া বেগম তাঁদের দেখেন। এভাবে হাসপাতালে একটা শিশু পেলেন। প্রতিবন্ধী। ট্রেনের নিচে পড়ে হাত-পা কাটা পড়ে গেছে শিশুটার। তারও কোথাও কেউ নেই। বাচ্চাটাকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেছেন তিনি। তাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করছেন। তার নাম দিয়েছেন বল্টু।

হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থাকে যে অজ্ঞাতনামা মানুষেরা, তিনি তাদের সবার দেখাশোনা করেন। তাদের মুখে খাবার তুলে দেন। তাদের গোসল করান। তাদের মলমূত্র পরিষ্কার করেন।

আলিয়া বেগমকে বলা হলো আপনাকে ঢাকায় যেতে হবে, আপনাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। তিনি বললেন, ‘না, আমি যাব না। আমার মানুষগুলোকে কে দেখবে? ওদের মুখে খাবার তুলে দেবে কে? ওদের পরিষ্কার করবে কে? আমি না থাকলে ওরা মারা যাবে।’

এ অনুষ্ঠানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘পাহাড় কিংবা সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে আমরা বুঝতে পারি, আমরা কত ছোট। আলিয়া বেগমের সামনে এসে আমরা সে রকমই বুঝতে পারছি।’

আর আমি বললাম, ‘আলিয়া বেগম আমাদের শেখালেন, মানুষ কত বড় হতে পারে।’

আলিয়া বেগম মঞ্চে উঠলেন। বললেন, ‘আমি তো কথা বলতে পারি না।’

প্রথম তিনি যে কথাটা বললেন, ১. আপনারা দেশকে ভালোবাসার কথা বলেন। আমি বলি, ‘দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকেও একটু ভালোবাসেন।’

তিনি কথা বলছিলেন, আর কাঁদছিলেন। আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনছি। শুনছি আর ভাবছি, তাই তো। দেশ মানে তো কেবল পতাকা না, মানচিত্র না, মাটি আর গাছ না, দেশ মানে মানুষ। দেশের মানুষ। একজন মানুষকেও কষ্ট দিয়ে কি দেশকে ভালোবাসা যায়? একটা মানুষের সেবা করলেও কি দেশের সেবা করা হয় না?

২. আলিয়া বেগম বলেন, আমি অজ্ঞাতনামা মানুষদের সেবা করি। কিন্তু আমরা যে কেউ যেকোনো সময় অজ্ঞাতপরিচয় হয়ে যেতে পারি। আপনি একটা চরে বেড়াতে গেলেন, গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, আপনাকে কেউ চিনছে না। আপনিই তো অজ্ঞাতনামা।

৩. আলিয়া বেগম বলেন, যে মানুষদের কেউ দেখে না, আমি তাদের দেখি। এতে যদি কোনো পুণ্য হয়, তাতে কি পরকালে আমি একটু ভালো থাকব না? আপনারা দোয়া করবেন, যেন আমি নিজে অজ্ঞাতনামা না হয়ে মারা যেতে পারি, আর যে কাজ করি, তার বদৌলতে যেন মৃত্যুর পর ভালো থাকি।

৪. তিনি কাজ করেন স্বেচ্ছায়, সেবার ব্রত নিয়ে। দিনে হাসপাতালে কাজ, রাতে বই বাঁধাই করে টাকা আয় করেন। তা দিয়ে তিনি অজ্ঞাতপরিচয় রোগীদের সেবা করেন। ওষুধ কিনে দেন। খাবার কিনে দেন। কেউ জোর করে তাঁকে টাকা দিলে তিনি মন খারাপ করেন। তার নিঃস্বার্থ কাজের আনন্দ বুঝি কেউ কেড়ে নিল। তিনি কি নিজেকে বিক্রি করে দিলেন?

৫. আলিয়া বেগম ভাবেন, আমি তো রাতের বেলা নিজের ঘরে লেপের নিচে শুয়ে আছি। হাসপাতালের বারান্দায় মেঝেতে কম্বলে শুয়ে রোগীরা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে। তাঁর যে সামান্য আয়, তাতে তঁার নিজের পেটই ভরে না। কিন্তু তিনি অজ্ঞাতপরিচয় রোগীদের খাওয়ান। তিনি বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে নিজে না খেয়ে থাকি, বোঝার চেষ্টা করি, অনাহারী মানুষদের কষ্টটা কেমন।’

আলিয়া বেগমের কথা শুনে ২২ ডিসেম্বর ২০২০ বিকেলে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনে সমবেত মানুষেরা সমুদ্র কিংবা পাহাড় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আমাদের প্রত্যেকের মনে হয়, নিজেকে নিয়ে বড় ব্যস্ত থেকে অনেক ছোট হয়ে আছি আমরা। একটু বড় হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজের ভেতরটাকে আরেকটু প্রসারিত করতে হবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক