আলী করিম

শহীদ বুদ্ধিজীবী, রেলওয়ে কর্মকর্তা, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম

আলী করিম

রেলওয়ের কর্মকর্তা হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন স্বাধীনচেতা আলী করিম। থাকতেন পাহাড়তলীর রেলওয়ে কলোনির পাঞ্জাবি লেনে।

একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রতিরোধযুদ্ধকালে ৫ এপ্রিল তাঁর বাসার সামনের পাহাড় থেকে পাকিস্তানি সেনারা মেশিনগানের গোলাবর্ষণ করে।

তখন পরিবারসহ তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। পরদিন গ্রামের বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর তাঁর তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।


এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পর সরকারি চাকরিজীবীদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

আলী করিম প্রথমে চাকরিতে যোগ দেননি। পরে আর্থিক সংকটের কারণে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হন এবং নিজ বাসায় থাকা শুরু করেন।

১০ নভেম্বর সকালে আলী করিম অফিসে রওনা হন। পথে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় অবাঙালিরা তাঁকে আটক করে।

পরে আরও অনেকের সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় আলী করিমের ছেলে গাজী সালেহউদ্দিনের ‘আমার বাবা’ রচনা থেকে।

সালেহউদ্দিন লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সরকার যখন বারবার চাকরিতে যোগদানের ঘোষণা দিচ্ছিল, বাবা এ ঘোষণা প্রথমে পাত্তা দেননি।

পরে যখন জানতে পারলেন অনেকে চাকরিতে যোগ দিয়ে কলোনিতে ফিরে এসেছে, তখন তিনি আর্থিক কারণে চাকরিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন।

ছোট ভাই ক্লাস ফোরে পড়ুয়া কামরানকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। ‘১৯৭১-এর ১০ নভেম্বর রোজ বুধবার ২০ রমজান, বাবা খুব ভোরে উঠে অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়ে আবার ফিরে আসেন।

এসে বাসায় অবস্থানরত কাকা আলী হোসেন (ইস্পাহানিতে চাকরি করতেন) ও গোফরান সাহেবকে (আমাদের গ্রামে বাড়ি, রেলওয়েতে চাকরি করতেন) সাবধান করে দিলেন, তাঁরা যেন তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও চলে যান।

বাবা তাঁদের জানান, আমাদের মহল্লা পাঞ্জাবি লেনে বিহারি, পাকিস্তান আর্মি ও সাদা কাপড় পরিহিত কয়েকজন লোক অস্ত্র, লাঠি ও রড নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।

তাদের হাবভাব ভালো নয়। বাঙালিদের গালাগালি করছে। শহর থেকে বাঙালিদের তাড়াবার কথা বলছে। এ কথা বলে বাবা আবার অফিসে রওনা হন।

‘এদিকে বাসা ছাড়ার আগেই আমাদের বাসা আক্রান্ত হয়। কাকা, গোফরান সাহেব, মান্নান সাহেব (আমাদের পাশে থাকত) ও ছোট ভাইকে বিহারিরা ধরে নিয়ে যায়।

ছোট ভাইয়ের বক্তব্য অনুযায়ী কাকাসহ ছোট ভাইকে ধরে পাহাড়তলী গার্লস স্কুলের মাঠে লাইন করে অনেক বাঙালিদের সঙ্গে মারধর করতে থাকে।

সাথে গালাগালি দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী কোথায়, সব বাঙালি হিন্দু। ‘ছোট ভাইয়ের মুখেই শুনি হত্যাকাহিনি। যাঁকে হত্যা করা হচ্ছে তাঁর গলা দিয়েই বিকট আওয়াজ বের হচ্ছে।

সেই আওয়াজে বধ্যভূমি কেঁপে উঠছিল। আর সেই আওয়াজ বন্ধ করার জন্য ছুরি দিয়ে পেট ফেড়ে দিচ্ছে ঘাতকরা। এরপর লাশটি নিস্তব্ধ হয়ে পড়ত।


‘ছোট ভাই কামরান বুদ্ধির জোরে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। তার বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমান পাহাড়তলী ফয়’স লেকের সন্নিকটে টেলিভিশন ভবনের সামনের বধ্যভূমিতে শত শত বাঙালির লাশের ওপর বাবার লাশও ছিল।

বাবার লাশ বহু লাশের ওপর চিত হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ খোলা, জিব বেরিয়ে পড়েছে (কোরবানি দেওয়ার গরুর যে অবস্থা হয়)।

গায়ের সাদা শার্ট দিয়ে হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, অষ্টম খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫)।

আলী করিমের জন্ম ১৯২০ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার বদরপুর গ্রামে। বাবা সামাদ আলী। ম্যাট্রিক পাসের পর আইএ পাস করে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে পড়া শেষ করতে পারেননি।

পরে বিএ পাস করেন। ১৯৪২ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে যোগ দেন।
আলী করিম স্কুলে পড়ার সময় মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুশীলন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

তবে অজ্ঞাত কারণে এই দলের কার্যক্রম নোয়াখালীতে বেশি দিন পরিচালিত হয়নি। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফার ঘোর সমর্থক হিসেবে কাজ করেন।


একাত্তরে চট্টগ্রামে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয়। তখন দাঙ্গাবিরোধী কাজে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাঙালিদের তিনি বোঝান, বিহারিরা আমাদের শত্রু নয়।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এটা একটি চাল। যাতে আমাদের স্বাধিকারের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু তাঁর এই সদিচ্ছার মূল্য পরবর্তী সময়ে অবাঙালিরা দেয়নি। আলী করিম সাত ছেলেমেয়ের জনক।


প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]