আলুর গুদামে আগুন ও উৎসবমুখর সর্বনাশ

সাহেদ করিম ও জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী।
সাহেদ করিম ও জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরী।

আলুর গুদামে আগুন লাগার মতো উৎসবমুখর সর্বনাশ আর নাই। গুদাম যখন জ্বলতে থাকে, তখন পোড়া আলুর সুবাসে আকাশ-বাতাস আলুময় হয়ে ওঠে। লোকজন ছুটে আসে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়া হাফ-সিদ্ধ, ফুল-সিদ্ধ আলু খেতে খরচা হয় না। কেউ জামার কোঁচড় ভরে তুলতে থাকে। কেউ বস্তা আনে। কেউ ধামা আনে। কেউ ধামার সঙ্গে ধামাধরা আনে। সবাই আলু কুড়ানোয় নেমে যান। গুদামের মালিক কে, আগুন লাগায় তার কত বড় সর্বনাশ হলো—এই সব ভাবার টাইম তখন থাকে না। কেউ আগুন নেভানোর জন্য এগিয়ে আসতে চাইলেও ভিড়ের ঠেলায় তাঁদের পক্ষে গোডাউনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। আগুনের শিখা দেখে দূরের লোক বুঝতে পারে, আলুর গুদাম পুড়ছে। অনেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মচ্ছবমুখর আলুপোড়া উৎসব শেষ হয়ে যায়। তারা তখন কপাল চাপড়াতে থাকে। আলুবঞ্চিত এই লোকেরা তখন ‘ফের গুদামে আগুন লাগলে মিস করা যাবে না’—এমন একটা প্রত্যয় নিয়ে বাড়ি ফেরে।

এ দেশের স্বাস্থ্য খাত, শিক্ষা খাত, ব্যাংক খাত, যোগাযোগ খাত, কৃষি খাত, পূর্ত খাত, বিদ্যুৎ খাত—ইত্যাকার বহু খাত আদতে একেকটা আলুর গুদাম। এই গুদামের দেখাশোনায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই না হলেও কিছু লোক সারা বছরই টুকটাক চুরিচামারি করেন। গুদামের যারা মালিক ওরফে জনগণ, সুদীর্ঘ দিনের এই ছ্যাঁচড়া চুরির চর্চা একরকমের মেনেই নিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটার পর একটা গুদামে আগুন ধরতে শুরু করেছে। একটা গুদামে আগুন ধরছে তো গুদামের ম্যানেজার থেকে শুরু করে গুদামঘনিষ্ঠ অধিবাসীরা পর্যন্ত ‘আলুকুড়ানি’ হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের ‘গোডাউনে’ বছর কয়েক ধরে ভয়াবহ ‘অগ্নিকাণ্ড’ ঘটে গেছে। সেই অগ্নিকাণ্ডে আগুন-টাগুন বিশেষ একটা দেখা যায়নি। তুলার গুদামের চোরা আগুনের মতো ভেতরে-ভেতরে পুড়েছে। গুদামের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই কেবল ঘটি, বাটি, ধামা, বস্তা ভরে টাকাগুলো নিজেদের হেফাজতে নিয়েছেন। পরে নিজেদের হেফাজতেও তা রাখা ঠিক হবে না মনে করে তাঁরা তা বিদেশের ব্যাংকের মজবুত কোনো ভল্টে রেখে এসেছেন।

দুই বছর আগে সিপিডি একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। তারা বলেছিল, গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ২০০৮ সালের পর জালিয়াতি, অনিয়ম ও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে এসব করা হয়েছে। লোপাট হওয়ার শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক, সেখান থেকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা জাস্ট ‘নাই’ হয়ে গেছে। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ও ফারমার্স ব্যাংকে ৫০০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাত শীর্ষক ‘আলুর গুদামে’ আগুন বহু আগে থেকে লেগেছিল। এই গুদামের আগুন ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, তারপর চলে গেলেন’ টাইপের আগুন না। এই আগুন দীর্ঘমেয়াদি। করোনায় এসে তার লেলিহান শিখা দেখা গেল। আগের পোড়া গুদামগুলো থেকে যঁারা আলু কুড়াতে পারেননি, এবার আর তাঁরা মিস করেননি। মোটামুটি সারা দেশের সব স্তরের আলুকুড়ানিরা বেশ ঘটিবাটি ভরে নিতে পেরেছেন।

দেশের অন্তত ২৭টি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটাসংক্রান্ত এক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে শুধু হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায়। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই কেনা হয়েছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। এসব যন্ত্রের বেশির ভাগই নিম্নমানের এবং অব্যবহৃত। মানে, যে মানুষ বাঁচানোর জন্য পাবলিকের টাকা খরচ করে যে যন্ত্র বসানো হয়েছে, তা আসলে মানুষ মারার যন্ত্র। করোনা আগুন যখন এ বছর স্বাস্থ্যের গুদামে হানা দিল, তখন দামি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি থেকে ত্রাণের চাল পর্যন্ত—সব ধরনের ‘আলু’ দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। যে যেভাবে পেরেছে কুড়িয়ে নিয়েছে। রিজেন্টের সাহেদ আর জেকেজির সাবরিনারা করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে আলু কুড়াতে এসে গুদামের মালিক ওরফে জনগণকে আগুনধরা গুদামে ঠেলে ফেলে মারার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহান আরেক ধাপ ওপরে উঠেছেন। তিনি আলু ধামা বোঝাই করার জন্য এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে এই চাকরি করে বেআইনিভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভুয়া মাস্ক সরবরাহ করলেন। তিনি আলু কুড়াতে এসে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ওরফে ডাক্তারদেরই আগুনে ফেলে মারার কায়দা করলেন।

পারস্যের বাদশাহ শাহরিয়ারকে রানি শাহরাজাদ যেভাবে গল্প শুনিয়েছিলেন, সেভাবে এই আলুকুড়ানি শাহেদ-সাবরিনা-শারমিনদের ‘আরব্য রজনীর গল্প’ হাজার রাত ধরে বলে গেলেও নটেগাছটি মুড়োবে না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অদ্ভুত নবাগত কিছু আলুকুড়ানির উদ্ভবে গুদামের মালিকদের বিপন্ন চোখ মহাবিস্ময়ে ট্যারা হয়ে গেছে। অদ্ভুত অদ্ভুত জাতের আলুকুড়ানিদের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বালিশ, বঁটি এসবের নাম করেও আলু কুড়ানো হচ্ছে।

এখন বন্যা এসে গেছে। বাঁধ ভাঙছে। ঘরবাড়ি ডুবছে। তার মানে পাউবো এবং ত্রাণবিষয়ক গোডাউনে আগুন লাগা সারা। বোঝা যাচ্ছে, আলুকুড়ানিরা এবার এই গুদামে দৌড়াবে। তাদের এই দৌড় থামবে না। তারা কুড়োতেই থাকবে। তারা কোনো দিন ক্লান্ত হবে বলে মনে হয় না। 

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]